দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু (ফাইল ছবি)

রায় পেতে ২৫ বছর, ক্ষতিপূরণ কবে?

১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় আহত হন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। এই ঘটনার একবছর পর ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের সহযোগিতায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে কাভার্ড ভ্যানটির মালিক বাংলাদেশ বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন নিহত মন্টুর স্ত্রী রওশান আখতার। বাংলাদেশ বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে দায়ের করা ওই মামলায় ২০০৫ সালের ২০ মার্চ ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করে। দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ নিহত সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ত্রিশ দিনের মধ্যে ২ কোটি ৪৭ হাজার ৮ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। বিবাদী পক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধেও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় দেন। ওই রায়ের পর দেড় বছর পার হওয়ার পরও বাদীপক্ষ ক্ষতিপূরণ পায়নি। এই প্রসঙ্গে বাদীর প্রশ্ন, ‘মামলার রায় পেতে কেটে গেলো ২৫ বছর, ক্ষতিপূরণ পাবো কবে?’

যেভাবে সাংবাদিক মন্টুর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়

সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর স্ত্রী রওশান আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য অফিসে একমাসের ছুটি চেয়েছিলেন। অফিস তার ১৫ দিন ছুটি মঞ্জুর করে। একটি এনজিওর কাজ ছিল তার হাতে। সেটা শেষ করতে ৩ ডিসেম্বর বিকালে বাসায় বসে লেখার কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে বাইরে যান। নয়াপল্টনের আনন্দ ভবনের সামনের সড়ক পার হয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাস্তা পার হয়ে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তখন সাড়ে ৫ টা হবে বিকাল। আমরা খবর পেয়ে দ্রুত স্কুটারে করে তাকে হলি ফ্যামিলিতে নিয়ে যাই। স্কুটারে বসেই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। হলি ফ্যামিলি কর্তৃপক্ষ তাকে সেখানে রাখতে চাইলো না। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ঢামেক হাসপাতালে তিনি ১৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরমধ্যে দুই বার তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়। এ সময় তাকে সিসিইউতে রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর তার সেখানেই মৃত্যু হয়।

ঘাতক গাড়িটি চিহ্নিত হয় যেভাবে

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনার পর ২২/২৩ বছর বয়সী পথচারী এক তরুণ ওই পিকআপ ভ্যানটি থামানোর চেষ্টা করেন। তিনি চিৎকার করেন। তবে কারও সহযোগিতা না পেয়ে তিনি নিজেই গাড়িটিতে ঝুলে পড়েন। ঝুলতে ঝুলতে তেজাগাঁও পেপসি কোলার তৎকালীন ডিপোতে যান। এই প্রসেঙ্গ নিহতের স্ত্রী রওশান আখতার বলেন, ‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায় শাহিনুর আলম নামে এক তরুণ ওই গাড়ির নম্বর ও চালকের নম্বর দেন। তখন আমরা বিষয়টি জানতে পারি। তরুণটি গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করতেন।’

যেভাবে ক্ষতিপূরণের মামলা

মামলা করার সময় ও মামলার শেষের সময় উল্লেখ করে রওশান আখতার বলেন, ‘পেপসি কোলার মালিক বাংলাদেশ বেভারিজ কোম্পানি লিমিটেডের মালিক আমানুল্লাহ মিয়া। ১৯৯১ সনে জানুয়ারিতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদ কর্তৃপক্ষ। মামলাটি পরিচালনা দায়িত্ব দেওয়া হয় দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আমিনুল হককে। যিনি পরবর্তী সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলাটি করেন। মামলার জন্য ৩০ হাজার টাকা যে কোর্ট ফি, তাও সংবাদ কর্তৃপক্ষ দেয়। মামলায় ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। আমিনুল হক অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার পর তার জুনিয়র ফরিদ আহমেদ (পরবর্তী সময়ে তিনি বিচারপতি হন) দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করেন। এরমধ্যে আমাদের মামলার ফাইল একসময় একজন্য ব্যারিস্টার নিয়ে হারিয়ে ফেলেন। আমি কেবল মামলার আর্জি ও বিবাদীর জবাবটা পাই। এর মধ্যে আমিনুল হক মারা যান। তখন আমি আরেকজন আইনজীবীর কাছে যাই। তিনি তখন আমাকে জানান, খরচ ছাড়া এই মামলা তিনি পরিচালনা করতে পারবেন না। তখন তিনি আমার মামলার কাগজপত্র দিয়ে দেন। আমি কাগজপত্র নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী একজনের মাধ্যমে আইনজীবী খলিলুর রহমানের সাক্ষাৎ পাই। তাকে মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব দেই। তিনি কাগজপত্র দেখে আমাকে বললেন, ‘আপনি তো কঙ্কাল নিয়ে এসেছেন। আর কাগজপত্র কোথায়? আমি তাকে বললাম, ফাইল হারিয়ে ফেলেছি।’ এরপর তিনি পুনরায় কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। মামলায় কিছু ত্রুটি ছিল, সেগুলোও তিনি ঠিক করলেন।’

আদালতের রায় ও বিবাদীর আপিল

মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলা দায়ের ১৪ বছর পর ২০০৫ সালের ২০ মার্চ বিচারিক আদালত মামলার রায় দেন। রায়ে সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। চালকের ভুলে মালিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও বিধান নেই উল্লেখ করে বিবাদী পক্ষ ওই বছরই বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন।

এই প্রসঙ্গে বাদী রওশান আরা বলেন, ‘আপিল করলেও তারা সময় নষ্ট করছে বছরের পর বছর। আপিলের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, বিবাদী পেপার বুক প্রস্তুত করে দেবে, তা তার করেনি। আমরা পেপারবুক প্রস্তুত করে আদালতে দেই। কজ লিস্টে আসে। শুনানি করতে প্রায় পাঁচ বছর লেগে যায়।

উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ২০১০ সালের ‍১১ মে বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে চালকের ভুলের কারণে মালিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পক্ষে মত দেন আদালত। ক্ষতিপূরণের টাকা কমিয়ে এবার ২ কোটি ৪৭ হাজার ৮ টাকা নির্ধারণ করেন।

এবার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদী পক্ষ আপিল করেন সু্প্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। সেই আপিলের রায় দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ বাদীকে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন। তবে এবার কোনও সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও ক্ষতিপূরণের জন্য অপেক্ষা

সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পরও ক্ষতিপূরণ না দেওয়ায় তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ডিক্রি জারির মামলা করেন বাদী রওশন আখতার। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেডের কোটি কোটি টাকা। তাই ইচ্ছা করলেই আমার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তারা ২৭ বছর ধরে আমাকে হয়রানি করছে। আমি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করেছি। তবে তখন ভালো করে কথা বলতে পারিনি। আরেকবার সুযোগ পেলে ভালো হতো। আমি বিষয়টি বোঝাতে পারতাম। আমি যেহেতু একটি নজির স্থাপন করেছি, এর সুবিধা সবাই পাবেন। তাই সবার স্বার্থে এই ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় আমাদের বড় ছেলের বয়স ৯ বছর আর ছোট ছেলে ছিল ৫ বছরের। তখনই আমি মামলা করেছিলাম। এই ২৭ বছরেও আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। উল্টো ১৯৯১ সালে নিম্ন আদালতের রায়ের ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ থেকে কমতে কমতে ১ কোটি ৬৯ লাখে এসে ঠেকেছে। গত ২৭ বছরে এই মামলা চালাতে গিয়ে সব হারিয়েছি। কিন্তু কিছুই পাইনি। এখনও মামলা চলছে।’

আইনজীবীর বক্তব্য

বাদী রওশান আরার আইনজীবী খলিলুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা রায় পেয়েছি। তবে বিবাদী পক্ষ টাকা দেয়নি। আমরা ডিক্রি জারি মামলা (রায় বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর যে মামলা করা হয়) করেছি। এরপরও ক্ষতিপূরণের টাকা পাইনি। অবশেষে আদালত তাদের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। তেজগাঁওয়ের জায়গা নিলামে বিক্রির নির্দেশ দিয়ে টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তবে নিলামে জায়গা বিক্রি করা যাচ্ছে না।’
-বাংলাট্রিবিউন

সম্পাদনা – ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম