ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ

বিচারকদের চাকরির গেজেট নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের ভিন্ন মত

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি সংক্রান্ত শৃঙ্খলাবিধি গেজেট প্রকাশ করার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন দেশের শীর্ষ আইনজীবীরা। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি, মাসদার হোসেন মামলার পরে অধস্তন আদালতের নিয়োগ পদ্ধতিটা একেবারেই সুপ্রিম কোর্টের হাতে। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির যে শৃঙ্খলাবিধি সরকার তৈরি করেছে তা সম্পূর্ণ আত্মঘাতী, অর্থহীন এবং অসাংবিধানিক।’

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ

শৃঙ্খলাবিধি গেজেট প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অনেক দিনের একটা দাবি ছিল, নিম্ন আদালতের বিচারকদের যারা ম্যাজিস্ট্রেসি করছে তাদের শৃঙ্খলাবিধি এবং আচরণবিধি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক। বিলম্বে হলেও এটা প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল আমার মনে হয়। বিধি প্রকাশের পর ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই। এই বিধি অনুযায়ী, নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো রকম অসদাচরণ বা অভিযোগ তোলা হয় তাহলে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে, সেটা বিস্তারিত আছে এখানে।

আগে যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল এই গেজেটে কতটুকু সুরাহা করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার তো মনে হয় এই বিধিতে সবকিছু কাভার করা হয়েছে। শুরুতেই আমাদের জানতে হবে মাসদার হোসেন মামলাটি যখন হয় এবং ২০০৭ সাল থেকে কিন্তু নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ থেকে আলাদা। এটা হয়েছে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী।

শফিক আহমেদ বলেন, ২২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷’ সেই প্রেক্ষিতেই কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীন। এখন প্রশ্ন হলো বিচার বিভাগে যারা কর্মরত বিশেষ করে অধস্তন আদালতে আচরণের শৃঙ্খলা বিধিটা এতদিন লিখিত আকারে ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আমাদের আইনমন্ত্রীর কয়েকটা সিটিং দিয়ে সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্ট একমত হয়েছে এবং সে আলোকেই কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এটা, তিনি যখন অনুমতি দিয়েছেন এটা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। ১১৬ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করে তা করার কথা।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, বিধি অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, অদক্ষতা যাই থাকুক কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাহলে বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই প্রসেসটা কমপ্লিট করার পরে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এই অদেশটি দেবেন। সরাসরি কোনো ফাইল রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারবে না। এটার প্রসেসটা হলো, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোনো ফাইল ইনিশিয়েট হলে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভার্বেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে।

এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমির উল ইসলাম বলেছেন, এই গেজেটর মাধ্যমে সরকারিকরণ করা হয়েছে পুরোপুরি এবং একই সঙ্গে মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা দিয়েছিল তার প্রতিফলন হয়নি বলে যে মন্তব্য করেছেন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি দেখছি আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বসে এই বিধিটা কিন্তু অ্যাপ্রোভ করা হয়েছে। কেউ বলতে পারবে না যে, উনাদের সঙ্গে বসে যেটা স্থির হয়েছিল তা বদলে দেয়া হয়েছে। এতে কিন্তু শুধু আচরণ বা শৃঙ্খলাবিধি না, নিয়োগের পদ্ধতি তো বললামই একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। তাহলে আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি মাসদার হোসেন মামলার পরে অধস্তন আদালতের নিয়োগ পদ্ধতিটা একেবারেই সুপ্রিম কোর্টের হাতে। আর সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বলতে এই না প্রধান বিচারপতির সঙ্গে। সুপ্রিম কোর্ট কি এখন চলছে না? আইন বা বিধি তো বাইবেল না যে, পরিবর্তন করা যাবে না। এটার কার্যকারিতা আছে, যদি এখনও মনে হয় অসুবিধা আছে তাহলে সংশোধন করা যেতে পারে। যদি এমন বিধান থাকে যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তবে সেটা সংশোধন করা যেতে পারে। আইনও তো বাতিল হচ্ছে। আর এটা তো বিধি।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে শফিক আহমেদ বলেন, আমি তো মিনিস্ট্রিতে ছিলাম। আমি দ্বৈত শাসনের কিছু দেখিনি। কোনো কাজই সুপ্রিম কোর্টের মতামত ছাড়া করা হয়নি।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ

এদিকে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির যে শৃঙ্খলাবিধি সরকার তৈরি করেছে তা সম্পূর্ণ আত্মঘাতী, অর্থহীন এবং অসাংবিধানিক।’

তিনি বলেন, ‘এই শৃঙ্খলাবিধি সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এর মধ্য দিয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকগণ সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।’

জাতীয় প্রেস ক্লাবের হল রুমে অপরাজেয় বাংলাদেশ আয়োজিত ‘মহান বিজয় দিবস ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান’শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

মওদুদ বলেন, ‘এই শৃঙ্খলাবিধির মাধ্যমে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের মৃত্যু ঘটেছে। মাজদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশ ছিল তার পরিপন্থী। সুতরাং এখন বলা যাবে না যে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক একটি প্রতিষ্ঠান।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে বিচার বিভাগের মতবিরোধ ছিল। কারণ তিনি এর বিরোধিতা করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে চেয়েছিলেন। সরকার তাকে বিতাড়িত করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে।’

শৃঙ্খলাবিধি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর একটি রাজনৈতিক আঘাত এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই বিধিমালা আইনজীবী সম্প্রদায়সহ দেশের কোনো শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং নিম্ন আদালতের বিচারকরা এই শৃঙ্খলাবিধি প্রত্যাখ্যান করবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন

এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, এই গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মামলার স্পিরিট ধ্বংস হয়েছে। গেজেটের মাধ্যমে বিচার বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির এই শীর্ষ আইনজীবী।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সোমবার নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম