ছবি- প্রতীকী

‘যাবজ্জীবন’ বিতর্কের অবসান হোক

জাহিদ হোসেন

যাবজ্জীবন যার বাংলা অর্থ যত দিন জীবন থাকে বা আমৃত্যু। কিছুদিন আগেও এক রায়ে এর আইনি অর্থ আমৃত্যু কারাবাস বলে অভিমত দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত -আপিল বিভাগ। যদিও এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমে বলেছেন, “প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ৩০ বছরের দণ্ড। যাদের যাবজ্জীবন দণ্ড হবে তাদের ৩০ বছরই কারাগারে থাকতে হবে। তবে যাদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হবে, তাদেরকে আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে”। যাহোক, আমাদের দেশে জেলকোড অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ৩০ বছর। তবে পেনাল কোডের ৫৭ ধারা অনুযায়ী এর মেয়াদ যে ৩০ বছর বলা আছে, তা সাজার ভগ্নাংশ হিসাব করার জন্য গণনা করা হয়। যেমন হত্যা মামলার সাজা – মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাথে জরিমানাও হতে পারে। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী জরিমানা অনাদায়ে কারাদণ্ড প্রদান করতে হয়। আর জরিমানা অনাদায়ে এই দন্ডের সর্বোচ্চ সীমা সংশ্লিষ্ট আইনে উল্লিখিত দন্ডের এক-চতুর্থাংশ।

তখন যাবজ্জীবন সাজার সাথে জরিমানা অনাদায়ে দন্ডের সীমা নির্ধারণ করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সীমা ৫৭ ধারা অনুযায়ী ৩০ বছর ধরে হিসাব করতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে জরিমানা অনাদায়ে সর্বোচ্চ আরো ৭.৫ (সাড়ে সাত) বছর দন্ড প্রদান করা যাবে। সেই ক্ষেত্রে ৫৭ ধারা অনুসারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে শুধু ৩০ বছর কারাদণ্ড নয়। যদি প্রশ্ন আসে, এই চার ভাগের এক ভাগ হিসেব করা হবে কিভাবে? তখন বলা হচ্ছে এই হিসেব করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ৩০ বছর ধরতে হবে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে দণ্ডবিধিতে যে ৫ (পাঁচ) ধরণের সাজার কথা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ আলাদা সাজা ৫৭ ধারায় ভগ্নাংশ-এর উপর ভিত্তি করে দেওয়া সাজার থেকে। যেমন: মূল শাস্তির অর্ধেক, বা চার ভাগের এক ভাগ ইত্যাদি।

আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কোন আসামি কাউকে হত্যার জন্য অন্য কোন ব্যক্তিকে প্ররোচিত করল, কিন্তু অপরাধটি যেকোন কারণে পরে আর সংঘটিত হয়নি। এক্ষেত্রে পেনাল কোডের ১১৬ ধারা অনুযায়ী প্ররোচনাকারীকে যাবজ্জীবনের ১/৪ (এক-চতুর্থাংশ) সাজা দিতে হবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি কখন মৃত্যু বরণ করবেন তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পেনাল কোডের ৫৭ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ ৩০ বছর ধরে প্ররোচনাকারীকে ১১৬ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাড়ে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

পূর্বে পেনাল কোডের ৫৭ ধারা অনুসারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ২০ বছর কারাদণ্ড ছিল। ১৯৮৫ সালে আইন পরিবর্তন করে এই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ করা হয় ৩০ বছর। তাই আবার আইন পরিবর্তন করে স্পষ্ট করে বলে না দিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে আমৃত্যু কারাদণ্ড বলে মনে করা হলে এখনো জনমনে বিভ্রান্তি থেকে যেতে পারে। আবার আইনে যাবজ্জীবন অর্থ ৩০ বছর যেমন উল্লেখ রয়েছে তেমনি আমৃত্যু কারাদণ্ডের কথাও উল্লেখ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সার্কুলারে কারাদণ্ডের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছিল। তখন থেকে এটিই প্রচলিত রয়েছে।

কারাগারে ভালো আচরণের জন্য জেল কোড অনুযায়ী ৩০ বছরের আগেও অনেক কয়েদি মুক্তি পান। গত কয়েক বছর ধরে আপিল বিভাগের কিছু রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে ‘আমৃত্যু’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান এটর্নি জেনারেলের মতেও দণ্ডবিধির ৫৩ ধারার সঙ্গে ৪৫ ধারা মিলিয়ে পড়লে যাবজ্জীবন অর্থ দণ্ডিত ব্যক্তির বাকি জীবন কারাবাস। তাই আপিল বিভাগ অথবা হাইকোর্ট বিভাগ যদি কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন এবং নির্দেশ দেন যে, কয়েদিকে বাকি জীবন (ন্যাচারাল লাইফ) কারা ভোগ করতে হবে, সেই ক্ষেত্রে ঐ মামলায় কারাভোগে রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে না। পেনাল কোডের ৫৫ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে আসামির সম্মতি ব্যতিরেকে এই সাজা কমিয়ে ২০ বছর করতে পারে। তবে আপিল বিভাগ বা হাইকোর্টের দণ্ড কমানোর পরও সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি যে কোনো দণ্ড মার্জনা, স্থগিত করতে ও কমাতে পারেন।

বৃটিশ আমলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলে আন্দামান দ্বীপে পাঠানো হতো। তখন সাত বছর থাকার পর দেশে ফিরে আসত কয়েদিরা। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে, আমাদের দেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সর্বোচ্চ ৩০ বছর বলে চলে আসছে। এর মধ্যে জেল কোড ও বিভিন্ন রেয়াদ রয়েছে। আবার জেল কোড অনুযায়ী ৯ (নয়) মাসে এক বছর হয়। এছাড়া আইজি প্রিজনেরও সাজা কমানোর ক্ষমতা রয়েছে। এই হিসেবে সব মিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ২০ থেকে ২২ বছর হতে পারে।

২০১৩ সালের আপিল বিভাগের একটি রায়ও রয়েছে, যেখানে যাবজ্জীবন সাড়ে ২২ বছর বলা হয়েছে। আবার প্রিজন আইনের ধারা ৫৯(৫)-এর ক্ষমতাবলে কারাবিধির অধ্যায় ২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই অধ্যায়ের বিধি ৭৫১(চ) অনুযায়ী যাবজ্জীবন সাজার অর্থ ৩০ বছর কারাভোগ বলা হয়েছে। কিন্তু দণ্ডবিধি ৫৭ অনুযায়ী ভগ্নাংশ গণনার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজার অর্থ ৩০ বছর গণনা করতে হবে। অন্যদিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৩৫(ক) ধারা অনুযায়ী মোট সাজার মেয়াদকাল থেকে বিচারিক সময়ের হাজতবাসের সময় বাদ দিয়ে এই হিসাব করতে হবে। কিন্তু যাবজ্জীবন সাজার অর্থ আমৃত্যু কারাভোগ হলে উপরে উল্লিখিত বিধানগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যাবজ্জীবন অর্থ আমৃত্যু কারাভোগের বিধান করতে হলে আইনের সংশোধন করে তা পরিষ্কার করতে হবে।

যাহোক, যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে হলো “Till last breath of his life” এটা আপীলেট ডিভিশন পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। তাই এটা নিয়ে বিতর্কেরও অবকাশ নেই। সাথে দরকার হলো, একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে প্যারোল প্রথা প্রচলন করা। যাতে একটা সময় বাধ্যতামুলক সাজা ভোগের পরে দন্ডিতকে আবার সমাজে পুনর্বাসন করা যায়। এত হিজিবিজি অবস্থা না করে একটা গাইডলাইন করেই ব্যাপারটার স্থায়ী সমাধান করা যায়।

লেখক : আইন বিষয়ক লেখক ও অধিকার কর্মী, নির্বাহী সদস্য, চুয়েলসা।