ওষুধে ভেজাল মেশালে যাবজ্জীবন

৩৫ বছর পর ওষুধ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মেডিক্যাল ডিভাইস ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ নতুন ইস্যুগুলো ওষুধ আইন ২০১৭-এর আওতায় আনা হচ্ছে। ওষুধে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন অথবা অনধিক ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রেখে ওষুধ আইন ২০১৭-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ওষুধ আইনে জনগণের চলার পথে ওষুধ বিক্রি, নিবন্ধন ছাড়া ওষুধ উৎপাদন, লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ উৎপাদন, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন আইনে সাজা কঠোর করা হয়েছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ড্রাগস অ্যাক্ট ১৯৪০ এবং ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুযায়ী ওষুধের উৎপাদন, মজুদ ও বাজারজাতকরণ হচ্ছে। কিন্তু এই আইন দিয়ে ওষুধ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৪০ সালের আইনে মোবাইল কোর্টে মামলা দেওয়া যেত এবং ১৯৮২ সালের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী মোবাইল কোর্টে মামলা দেওয়া যেত না। এখন পুরনো আইন দুটিকে একীভূত করে এবং নতুন কিছু ধারা সংযোজন করে ওষুধ আইন-২০১৭ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে মোবাইল কোর্টে মামলা দেওয়া যাবে এবং শাস্তিও বাড়ানো হচ্ছে। নতুন আইনে ওষুধ উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান কঠোর করা হচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. গোলাম কিবরিয়া আমাদের সময়কে বলেন, এতদিন ওষুধের উৎপাদন, মজুদ ও বাজারজাতকরণ সব কিছুই ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০ এবং ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুযায়ী পরিচালিত হতো। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওই দুটি আইন একত্রিত করে একটি নতুন আইনের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করেছি। এই আইনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, মেডিক্যাল ডিভাইসসহ নতুন যে ইস্যুগুলো আছে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন কিছু ধারাও সংযোজন করা হয়েছে। আগের আইনে যে সাজাগুলো ছিল সেগুলো বাড়ানো হয়েছে। এক কথায় সময়ের চাহিদামতো ওষুধ আইন প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ হয়ে পার্লামেন্টে পাস হবে।

এ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ওষুধের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, বিক্রি, মজুদ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও বিতরণ এবং মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ওষুধ সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন রহিত করে, পুনঃপ্রণয়ন করে, অধিকতর সংশোধিত ও একীভূত করে ওষুধ আইন প্রণয়ন করা হলো।

ওষুধ আইনের খসড়ার ৩৮ নম্বর ধারার উপধারা (১) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ওষুধে ভেজাল করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা অনধিক ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া ৩৯-এর ১ উপধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভেজাল ওষুধ মজুদ, বিক্রি ও বিতরণ বা প্রদর্শন করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা অনধিক ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ওষুধ আইনের ৪০-এর উপধারা (১) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি ও বিক্রির উদেশ্যে মজুদ বা প্রদর্শন করলে তিনি অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড, ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনের ৪১-এর উপধারা (১) অনুযায়ী, লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করলে তিনি অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ডে বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যের থেকে বেশি মূল্যে কোনো ওষুধ বা ওষুধ তৈরির কাঁচামাল বিক্রি বা আমদানি করলে অনধিক দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কোনো ব্যক্তি সরকারের কোনো ভাণ্ডার, হাসপাতাল ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কোনো ধরনের ওষুধ চুরি বা বিক্রি বা বিক্রির উদ্দেশ্যে তার অধিকারে রাখলে অনধিক ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড দণ্ডিত হবেন।

কোনো ব্যক্তি মিসব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন, মজুদ বা বিক্রি করতে পারবেন না। এটি লঙ্ঘনকারী অনধিক ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩৬-এর উপধারা (১) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন, মজুদ বা বিক্রি করতে পারবেন না। এটি লঙ্ঘনকারী অনধিক ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ, মজুদকরণ, প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারবেন না। এটি লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কোনো ব্যক্তি নিবন্ধন ছাড়া ওষুধ উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ, মজুদকরণ, প্রদর্শন ও বিক্রি করলে অনধিক ১০ বছর সশ্রম কারাদ-ে বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জনগণের চলার পথ, মহাসড়ক, ফুটপাত, পার্ক, গণপরিবহন বা ঘুরে ঘুরে ফেরি করে অ্যালোপ্যাথিক, হারবাল, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিকসহ কোনো ধরনের ওষুধ বিক্রি করলে তিনি অনধিক দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া ওষুধ আইনের খসড়ায় বেআইনিভাবে বিজ্ঞাপন, মিথ্যা নিশ্চয়তা প্রদান, পরিদর্শককে কাজে বাধাদান করলে তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

খসড়ায় জাতীয় নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ওই পরীক্ষাগার ওষুধের পরীক্ষা, গবেষণা ও বিশ্লেষণ সনদ দেবে।
এ ছাড়া ওষুধ আইন ২০১৭-এর খসড়ায় একটি ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম