বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আইন প্রণেতারা কি উদ্দেশ্যে আইন করছেন তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে না

‘আইন প্রণেতারা কী উদ্দেশ্যে আইন করছেন তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি আশরাফুল কামাল। এ যুক্তিতে তিনি রিট খারিজ করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে তার নিজস্ব সীমা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

এর আগে রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ কিংবা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কারণে সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়া-সংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টের জারি করা রিটে দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি রুল জারি করলেও জুনিয়র বিচারপতি তা খারিজ করেছেন বলে জানান আইনজীবীরা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানিতে সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ড. মো. ইউনুছ আলী আকন্দ নিজেই।

জেষ্ঠ্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী তার আদেশে বলেন, সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। কিন্তু সংবিধানে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ থাকায় জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ থাকার কারণে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন। তারা নিজ দলের কাছে পরাধীন। দল যা বলবে তাই করতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সব ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক দল, জনগণ নয়।

আদেশে বলা হয়, শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, ওইসব দেশে আইন প্রণেতারা স্বাধীনভাবে মতামত দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, ওইসব দেশে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কোনো অনুচ্ছেদ নেই। ওইসব দেশের আইন প্রণেতাদের সঙ্গে আমাদের সংসদ সদস্যদের মৌলিক পার্থক্য নেই। আমাদের দেশে দলীয় হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে যাবার সুযোগ নেই।

বেঞ্চের জেষ্ঠ্য বিচারপতি আরও বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় এ আদালত (হাইকোর্ট) ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে অভিমত দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, আপিল বিভাগের দেয়া রায় আমাদের (হাইকোর্ট) জন্য মানা বাধ্যতামূলক। এ রিট আবেদনে রুল জারির মতো প্রাথমিক উপাদান রয়েছে। এ কারণে রুল জারি করা হলো।

অন্যদিকে কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি খারিজ করে দেয়া আদেশে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্ট যে অভিমত দিয়েছে তা আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন ঠিক। তবে ষোড়শ সংশোধনী মামলা ছিল বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত। সেখানে বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে ৭০ অনুচ্ছেদ বিচার্য ছিল না। এ বিচারপতি বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। সে সময় যেভাবে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেভাবেই রয়েছে। এ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে অতীতে কোনো সরকার বা সংসদে প্রশ্ন ওঠেনি। জনগণও প্রশ্ন তোলেনি। ৭০ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার হয়েছে এমন নজিরও আমাদের সামনে নেই।

আদেশে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে, আদালত সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করে না। শুধুই বলতে পারে, সংসদে প্রণীত আইন সংবিধান পরিপন্থী কিনা। এ কারণেই তো সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে রায় দিয়েছেন। আদেশে বলা হয়, রিট আবেদনকারী তার আবেদনে বলেননি যে, ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের আর কোন কোন অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেননি যে, আইন প্রণেতা কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনগণ সকল ক্ষমতার অধিকারী। আর সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইন প্রণয়নে আদালত বাধ্য করতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, কার্যত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্যই আদালতের সৃষ্টি। আদালতের দায়িত্ব সেটাই। বিচার বিভাগকে তার নিজস্ব সীমা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আইন প্রণেতারা কি উদ্দেশ্যে আইন করছেন তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে না।

(জাগো নিউজ)