কক্সবাজারে যাঁরা জেলা জজের দায়িত্ব পালন করেছেন
বিচারক (ছবি - প্রতীকী)

ডিভোর্স ঠেকাতে দম্পতিকে নিভৃতে হোটেলে থাকার নির্দেশ, খরচ বিচারকের

বিচারকের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে ভাঙা মন এক হল ভারতের সিউড়িতে। যে গৃহবধূ স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, বিচারকের নির্দেশে তিনিই আদালত থেকে স্বামীর হাত ধরে সটান চলে গেলেন সিউড়ির একটি হোটেলে। ভাঙা সম্পর্ক জুড়তে আপাতত সেখানেই তিন দিন থাকবেন দম্পতি। হোটেলের থাকার খরচও তিনিই বহন করবেন বলে দম্পতিকে আশ্বাস দিয়েছেন ওই বিচারক।

সিউড়ি আদালতের বিচারক পার্থসারথী সেনের এই উদ্যোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আইনজীবী থেকে কোর্ট চত্বরে উপস্থিত সকলেই। এমনকী, বিবাদমান ওই দম্পতির পরস্পরের প্রতি মনোভাবও যেন ওই একটি পরামর্শেই বদলে গিয়েছে।

গত বছরের ২ মার্চ সিউড়ির ভট্টাচার্য পাড়ার যুবক প্রশান্তর (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে বিয়ে হয় নদিয়ার তেহট্টের বাসিন্দা কাবেরীর (নাম পরিবর্তিত)। অল্প সময়ে সাংসারিক কলহ থাবা বসায় নবদম্পতির জীবনে। কলহ মেটাতে বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে তোলেন স্বামী। তাতেও মেটেনি দাম্পত্য কলহ। এর পরেই স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে জেলা আইনি সহায়তা কেন্দ্রের দ্বারস্থ হন নববধূ।

গত ৮ জানুয়ারি সেই আবেদনের শুনানির দিন থাকলেও মীমাংসা তো দুরের কথা বরং বিবাদের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নববধূ স্বামীর বিরুদ্ধে সটান বধূ নির্যাতনের মামলা করে বসেন। স্বামী, শ্বশুর ও ভাসুরের বিরুদ্ধে কাবেরী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। এমনকী স্বামী তাঁকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন স্ত্রী। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাও হয়েছে বলেও দাবি কাবেরীর। শ্বশুরের বিরুদ্ধে তাঁর দিকে কু-নজরে দেখা ও কু-প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগও আনেন ওই গৃহবধূ। হেনস্থার অভিযোগ আনেন ভাসুরের বিরুদ্ধেও।

বধূর অভিযোগ পেয়ে সিউড়ি থানা ভারতীয় দন্ডবিধির ৪৯-এ (বধূ নির্যাতন), ৩০৭ (খুনের চেষ্টা), ৫০৬(হুমকি) ও ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি) প্রভৃতি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে। সেই মামলায় অভিযুক্ত বধূর স্বামী তাঁর আইনজীবী মারফত আগাম জামিনের আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে সোমবার ছিল শুনানি।

আগাম জামিনের আবেদনের খবর পেয়ে কাবেরী দেবীও আইনজীবী মারফত আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে জামিনের বিরোধিতা করেন। বিচারক পার্থসারথী সেন দুই পক্ষের আবেদন শুনে ডেকে পাঠান দু’জনকেই। এজলাসে হাজির হন দম্পতি। বিচারক সমস্যার কথা জানতে চাইতেই তেড়েফুঁড়ে ওঠেন দু’জনেই। স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে বলেন, ‘‘দেখুন, আমার হাত মুচড়ে দিয়েছে। আমাকে প্রায় মারধর করে। চরম অত্যাচার করে। আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করেছে।’’

স্ত্রীর অভিযোগ শুনে সরব হন স্বামীও। পাল্টা অভিযোগে বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী সংসার করতে চান না। ওঁকে নিয়ে আলাদা ভাড়া বাড়িতে থেকেও সমস্যা মেটেনি। আমার ষাট বছরের বাবার বিরুদ্ধেও নোংরা অভিযোগ তুলেছেন। আমাকে মারধর করে। ওঁর সঙ্গে থাকলে আমাকে মেরে ফেলবে।’’

স্ত্রী স্বামীকে মারধর করেন শুনে বিচারক প্রশান্তবাবুর কাছে জানতে চান তাঁর ওজন কত? উত্তরে স্বামী বলেন, ‘‘৭২ কেজি।’’ স্ত্রীকেও একই প্রশ্ন করলে উত্তর আসে ‘৫৭ কেজি।’’ মুচকি হাসেন বিচারক।

শুনানি স্থগিত করে বিচারক দু’জনকে পরামর্শ দেন সাতদিনের জন্য ভাড়া বাড়িতে থাকার। আপত্তি তোলেন স্বামী। এর পরেই বিচারক মেজাজ চড়িয়ে বলেন স্ত্রী-র সঙ্গে যান না হলে জেলে যেতে হবে। স্বর নিচু হয়ে যায় স্বামীর। নিজের আর্থিক দুর্বলতার কথা বিচারককে জানান তিনি।

অবশেষে বিচারক তিনদিন হোটেলে থাকার নিদান দেন। হোটেলের খরচের ভারও নিজের কাঁধে নিয়ে নেন বিচারক। সেই সঙ্গে সিউড়ি থানার আইসি-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দম্পতি যেন হোটেলে তিনদিন নিভৃতে নিজেদের মতো করে কাটাতে পারেন এবং বাইরের কেউ যেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখা না করেন।

এ বিষয়ে সিউড়ি আদালতের সরকারি আইনজীবি রঞ্জিত গঙ্গোপাধ্যায় জানান, “মাত্র ক’দিন হল ওঁদের বিয়ে হয়েছে। যে বিষয়গুলি নিয়ে ওঁদের মধ্যে মনোমালিন্য সেগুলি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাই বিচারকের সঙ্গে আলোচনা করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।’’

বিচারকের নিদানেই বদলে যায় স্বামী-স্ত্রী- র ‘শরীরী ভাষা’। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় দু’জনে পরস্পরের হাত ধরে আদালত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন করতেই স্বামী প্রশান্তর উত্তর, “বিচারকের পরামর্শ মাথা পেতে গ্রহন করেছি।’’ সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী-র জবাব, “ওঁর উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।’’

এজলাস, কাঠগড়া, সেরেস্তা, উকিল, মক্কেলদের পিছনে ফেলে গুটি গুটি পায়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে যান ‘বিবাদমান’ দম্পতি। হোটেল থেকে আবার এজলাসে তাঁরা ফিরবেন আগামী ১৯ জানুয়ারি। দু’জনের মত বদলাবে কি, অপেক্ষায় সকলেই। সূত্র : এবেলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম