আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পথে চলা

হাফিজুর রহমান কার্জন: 

গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ফৌজদারি আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও কয়েকজনের সাজা হয়েছে দশ বছর করে। অর্থদণ্ডও হয়েছে। এ রায়ের পর এখন বিভিন্ন মহলে অনেক প্রশ্ন- তিনি কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন? তার বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল চার দশকের রাজনৈতিক জীবনেই-বা এর কী প্রভাব পড়বে। রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। এখন চলছে আপিলের প্রক্রিয়া।

এ রায় বিষয়ে আইনের ছাত্র হিসেবে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া এভাবে ব্যক্ত করতে চাই- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হলো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে- সেটা বলব না, সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কেন এ কথা বলছি? কারণ বাংলাদেশে এখনও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিকতা পুরোপুরি রূপলাভ করেনি। অন্যদিকে আইনের নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিয়ে অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন রয়েছে। এ দ্বিধা নিয়েই বলছি, সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে এতদিনের যে মিথ ছিল- কেউ কেউ আইনের ঊর্ধ্বে, অনেকের ক্ষেত্রেই আইনের সব ধারা প্রয়োগ করা যায় না, সেটা ভেঙে গেল। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢালাও গ্রেফতার এবং অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদানের ঘটনা ঘটতে থাকলে এমন একটি ধারণা আমাদের হয়েছিল। কিন্তু সেটা টেকসই হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি কথাটি দেশে চালু আছে। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে অপসংস্কৃতি, যা পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক সময়ে বিচারহীনতার ধারা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্নমুখী চেষ্টা লক্ষ্য করি। প্রথমেই বলতে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এমনকি দীর্ঘ ২১ বছর সামান্য এজাহারও দাখিল করা হয়নি। অথচ স্বাধীনতার স্থপতি ও দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে হতে না পারে, সে জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে বাতিল করা হয়।

আমরা স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পর মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত কয়েকজনের বিচার ও দণ্ড কার্যকর হতেও দেখেছি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও লুটপাট-অগ্নিসংযোগে সক্রিয় সহযোগীরাও নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্বে মনে করেছিল। তাদের কেউ কেউ এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হয়। মন্ত্রী-এমপি হয়। এ বিচার কাজও ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাগ্রতা ও আন্তরিকতার কারণেই এ বিচার কাজ পরিচালিত হতে পেরেছে। জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দণ্ড যেন কার্যকর না হয় সে জন্য দেশি-বিদেশি চাপ ছিল অনেকটা প্রকাশ্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাতে দমে যাননি। এ বলিষ্ঠ অবস্থানের জন্য আমাদের গৌরবের জাতীয় ইতিহাসে তিনি বিশেষ স্থান পাবেন, সন্দেহ নেই।

আমরা চট্টগ্রামে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সার-কারখানার জেটি থেকে দশ ট্রাক অস্ত্র খালাসের মামলার নিষ্পত্তি হতেও দেখেছি। এ মামলায় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর নেতা (১৯৭১ সালে কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তি) মতিউর রহমান নিজামীসহ ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা অভিযুক্ত ছিলেন। অনেকে দণ্ডিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিদ্রোহী কোনো গোষ্ঠীর জন্য অস্ত্রের যে চালান আনা হয়েছিল তা ব্যবহার করে বড় ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা সম্ভব, এমন কথা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্নেষকরা। কিন্তু এ গুরুতর অপরাধে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের গোয়েন্দা কর্তা-ব্যক্তিসহ কেউই রেহাই পায়নি।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলাতেও চ্যালেঞ্জ ছিল, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ যেখানে জড়িত, র‌্যাবের অফিসাররা যেখানে জড়িত, সেখানে বিচার কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন হবে কি? রাজনীতির বিষয়টিও এসেছে। কারণ মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি নূর হোসেনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রকাশ্য।

কিন্তু আমরা দেখেছি, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হয়। এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।

কিন্তু বিচার কাজ যে থমকে নেই, সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলায় ট্রায়াল কোর্টে দণ্ড হয়েছে। এখন আপিল হবে। সবার সামনে প্রশ্ন, খালেদা জিয়া কি নির্বাচন করতে পারবেন? এ বছরের শেষ নাগাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় এ সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি বদ্ধপরিকর, এটা এমনকি দলের নেতারা খালেদা জিয়ার শাস্তির পরও বলেছেন। তারা বলছেন, কোনোভাবেই তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা যাবে না।

দুর্নীতির মামলায় কেউ দণ্ডিত হলে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে সংবিধানে কী বলা আছে দেখা যাক- কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না যদি ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অনূ্যন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ৬৬-২ (ঘ) অনুচ্ছেদ। এ ধারায় সবকিছুই স্পষ্ট মনে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখেছি? আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক আলোচিত মামলার রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, আদালতের রায় আছে দুটি- আপিল চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত একটি রায় বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে, অন্যটি বলছে যাবে না। একই সঙ্গে আমরা এটাও দেখছি যে, দুর্নীতির মামলায় শাস্তিলাভের পরও রাজনীতিকদের সংসদে থাকা না থাকার বিষয়ে আইনের চেয়ে রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে। ১৯৯৩ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জনতা টাওয়ার মামলা দায়ের হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে। এ মামলার রায় প্রদান করা হয় ২০০০ সালে, যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। রায়ে এরশাদ সাহেব জাতীয় সংসদে অযোগ্য ঘোষিত হন। কিন্তু আমরা সে সময়ে সংবাদপত্রে দেখি, সংসদে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া সমবেদনা জানাতে সাবেক রাষ্ট্রপতির বাসভবনে গিয়েছেন।

আমরা জানি, রায় যদি পরস্পরবিরোধী হয় কিংবা অস্পষ্টতা থাকে, সে ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ যেটা বলবেন সেটাই অনুসরণ করতে হবে। আমরা এটাও দেখি যে, আদালতের দণ্ড মাথায় নিয়েও কেউ কেউ মন্ত্রিসভা কিংবা সংসদের সদস্যপদে বহাল রয়েছেন।

এসব অভিজ্ঞতার পরও আমি মনে করি, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ জজ আদালতের রায় ইতিবাচক। আমাদের শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় অনেক স্পর্শকাতর দিক রয়েছে। কিছু কিছু বিষয় রীতিমতো নাজুক, ব্যাখ্যাতীত। কিন্তু এ মামলা আইনের শাসনের পথে চলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বিচার কাজ পরিচালিত হয়েছে স্বচ্ছতার সঙ্গে। মামলা চলবে কি চলবে না, বিচারক পরিবর্তন এবং এ ধরনের আরও কিছু বিষয়ে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে বারবার গিয়েছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগও তিনি পেয়েছেন। আমরা বলতে পারি, তিনি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেছেন এবং রায় মাথা পেতে নিয়েছেন। এখন তিনি আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়, সে জন্য উভয় পক্ষের ছাড় প্রদান কাম্য। কাঙ্ক্ষিত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে সম্মিলিত প্রয়াস চাই। বিএনপি রায়ের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। একই সঙ্গে আইনি লড়াইও চলবে। তাদের এ অবস্থান প্রশংসনীয়। রায়ের পর এ পর্যন্ত দেশের কোথাও বড় ধরনের অশান্তি ঘটেনি। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এগিয়ে চলতে হলে এ ধরনের মনোভাবই কাম্য।

দুর্নীতির এ মামলা বর্তমানে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন এবং ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে যাচ্ছে- কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতি হলে বিলম্বে হলেও শাস্তি পেতে হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনেক মামলায় তড়িঘড়ি দণ্ড দেওয়া হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের। সেসব মামলার অধিকাংশই পরে উচ্চ আদালতে টেকেনি। কিন্তু এখন চলছে গণতান্ত্রিক শাসন এবং এ পথেই আমরা চলতে বদ্ধপরিকর।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়