সংবিধানে অশুদ্ধ বানান

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে রয়েছে বেশকিছু অশুদ্ধ বাংলা বানান। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমি এসব বানান পরিমার্জন করে সঠিক করলেও সংবিধানে এখনও তা অনুসরণ করা হয়নি। অবশ্য সরকার দাফতরিক কাজে বর্তমানে এসব বানান লিখতে প্রমিত বাংলা বানানের রীতি অনুসরণ করছে। সংবিধান ছাড়াও ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’,‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’সহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানে আইনি বাধ্যবাধকতায় অশুদ্ধ বানানের চর্চা হচ্ছে।

আইনি বাধ্যবাধকতায় সংবিধানসহ কিছু ক্ষেত্রে অশুদ্ধ বানান থাকতে পারে মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করে এগুলো দ্রুত সঠিক নিয়মে লেখার কথা বলেন।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানানের নিয়ম বাংলাদেশ অনুসরণ করে আসছিল। কিন্তু এতে বেশকিছু ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এরই মধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পাঠ্যবইয়ে অভিন্ন ও শুদ্ধ বাংলা বানান যুক্ত করার জন্য ১৯৮৮ সালে কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া তৈরি করে। পরে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নকারী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ১৯৯২ সালে।

২০০০ সালে এই নিয়মের কিছু সূত্র সংশোধন করা হয় এবং তা ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর পরিমার্জিত সংস্করণের পরিশিষ্ট হিসেবে মুদ্রিত হয়। সর্বশেষ আরও কিছু পরিমার্জন করে ২০১২ সালে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ‘পরিমার্জিত সংস্করণের প্রথম পুনর্মুদ্রণ’ প্রকাশ করে। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এটা অনুসরণ করে পাঠ্যবই প্রণয়ন করছে। এছাড়া, এর আলোকেই সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘সরকারি কাজে বাংলা’ পুস্তক আকারে প্রকাশ করে সরকারি পর্যায়ে তা অনুসরণ করার জন্য পরিপত্র জারি করে। এতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম হুবহু তুলে দেওয়ার পাশাপাশি সচরাচর ভুল হয় এমন তিন হাজারের বেশি শব্দের সঠিক ও সম্ভাব্য ভুল বানান তুলে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ মুদ্রিত (এপ্রিল-২০১৬) সংবিধান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শহীদ, খ্রীষ্টাব্দ, খ্রীষ্টান, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, সুপ্রীম কোর্ট, নির্বাচনী, সরকারী, বেসরকারী, বিধানাবলী, মেহনতী, মজুরী, শ্রেণী, ফৌজদারী, জারী, মঞ্জরী,দাবী, ইংরেজী,ডিক্রী, রীট, চাকুরী, ঊনআশী, কর্মসূচী, মুলতবী, শর্তাবলী, বাঙালী ইত্যাদি শব্দগুলি ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী)-এ লেখা হয়েছে। কিন্তু প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে সবগুলো শব্দেই ‘হ্রস্ব ই-কার’ (ি) হবে। যেমন- স্পীকারের স্থলে স্পিকার, মজুরীর স্থলে মজুরি ইত্যাদি। এছাড়া বানানের নিয়মে ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দটি সঠিক হলেও এর স্থলে ‘এ্যাডভোকেট’, ‘দণ্ড’ শব্দটির স্থলে ‘দন্ড’, ‘অসামঞ্জস্য’-এর স্থলে ‘অসামঞ্জস’, ‘খ্রিস্টান’-এর স্থলে ‘খ্রীষ্টান’ লেখা হয়েছে।

সংবিধানের মুদ্রণ কপি ছাড়াও আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে সংবিধানের যে সফট্ কপি আপলোড করা হয়েছে সেখানেও এগুলোর বাইরে বেশকিছু অশুদ্ধ বানান রয়েছে।

এদিকে ‘গোষ্ঠী’ শব্দটি ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী) হলেও সংবিধানের উপক্রমণিকা অংশে আইনমন্ত্রী শব্দটি ‘হ্রস্ব ই-কার’ (ি) দিয়ে লিখেছেন। উপক্রমণিকায় ‘দাবি’ শব্দটিকে একবার ‘হ্রস্ব ই-কার’ (ি), অন্যবার ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী) লেখা হয়েছে।

সংবিধান ছাড়াও সরকারের বেশকিছু দফতর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম অশুদ্ধ বানানে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ও রূপালী ব্যাংক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, সরকারী কর্ম কমিশন, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, ঢাকা পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী, বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ইত্যাদি।

সংবিধানে অশুদ্ধ বানান সম্পর্কে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম বইয়ের রচয়িতা কমিটির সদস্য ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘সংবিধানের কিছু অশুদ্ধ বানান আমাদের নজরে এসেছে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া এগুলো ঠিক করা সম্ভব নয় বলেই হয়তো এটা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমি থেকে আমরা বানান ঠিক করে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যদি সংবিধানের সংঘর্ষ হয়,তাহলে জনগণ তো আমাদেরটা মানবে না, দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানেরটাই মানবে।

‘আমরা প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ঠিক করে তা সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য সরকারসহ সবাইকে অনুরোধ করেছি। বর্তমান পাঠ্যপুস্তকও নতুন বানানরীতি অনুসারে প্রণীত হচ্ছে। আমাদের অনুরোধ থাকবে সবাই যেন সঠিক বানানরীতি ব্যবহার করে। সরকারের কোনও দফতরের ক্ষেত্রে আইন সংশোধনীর প্রয়োজন থাকলে, তা দ্রুত করতে পারে।’

প্রমিত বাংলা বানানরীতি সর্বত্র চালু হয়ে গেছে উল্লেখ করে এই ভাষাবিদ বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি সরকার সংবিধানের একটি সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছে। খুব শিগগিরই হয়তো এটা হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশ থাকবে সংবিধানের এই নতুন সংশোধনীর সময় প্রমিত বাংলা বানানের রীতি অনুসারে যেসব অশুদ্ধ শব্দ রয়েছে সেগুলো যেন ঠিক করা হয়।’

অবশ্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে সংবিধানে যেসব অশুদ্ধ বানান রয়েছে তা সঠিকভাবে লেখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে সংশোধনীতে যুক্ত করার দরকার হলে তা বিবেচনা করে দেখবেন বলে জানান তিনি।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, যিনি নিজেও ‘স্পিকার’ শব্দটি ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী)-এ সঠিক বলে জানেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তিনি তো জানেন ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী) দিয়ে ‘স্পিকার’ লিখতে হয়। বাংলা একাডেমি এটাকে ‘হ্রস্ব ই-কার’ (ি) করেছে, এমন তথ্য তিনি জানেন না। পরে অবশ্য তিনি জানান, সংবিধান ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘স্পিকার’ শব্দটি ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী) দিয়ে লেখার কারণে সংসদ সচিবালয় সেটা অনুসরণ করে।

শিশু একাডেমীর পরিচালক আনজীর লিটন বলেন, ‘প্রমিত বাংলা বানান নিয়মে “একাডেমি” বানানটি “হ্রস্ব ই-কার” (ি)দিয়ে হবে। কিন্তু আমাদের শিশু একাডেমীর আইনটিতে “দীর্ঘ ঈ-কার” (ী) রয়েছে। এই আইনের কারণেই আমরা সঠিক বানানটি ব্যবহার করতে পারছি না।’ তবে, আইনটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানে সঠিকভাবেই লেখা হবে বলে জানান তিনি। বাংলা ট্রিবিউন