বাংলায় রায় লেখা হাইকোর্টের ব্যতিক্রম দুই বিচারপতি

উচ্চ আদালতে বিচারকাজে নিয়োজিত আছেন ৮৪ জন বিচারপতি। তবে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তারা হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চে জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সঙ্গে বিচারকাজে নিয়োজিত থাকলেও নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে থাকেন। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তার আট বছরের কর্মজীবনে কখনোই বাংলা ভাষার বাইরে গিয়ে রায় ও আদেশ লেখেননি। তার রায় ও আদেশের সংখ্যা ইতিমধ্যে সাত হাজার ছাড়িয়েছে, যা এককভাবে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অন্যদিকে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালও গত ১৭ আগস্ট থেকে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে যাচ্ছেন, যার সংখ্যা ৫০টিরও বেশি।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখার বিষয়টি বিচারপতিদের সদিচ্ছার বিষয়। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এই দুই বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে এটাই প্রমাণ করেছেন। তারা যেভাবে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে যাচ্ছেন, তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার না হওয়ার পেছনে পাঁচটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিচারপতিদের বাংলায় রায় লেখার মানসিকতার অভাব; দ্বিতীয়ত, বিচারকদের বক্তব্য (ডিকটেশন) বাংলায় সহজে ও দ্রুত লিখতে না পারা; তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় আইনের তেমন প্রতিশব্দ না থাকা; চতুর্থত, আইনের সব ভাষ্য ইংরেজিতে হওয়া এবং বহির্বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো ইংরেজিতে হওয়ায় তা নজির হিসেবে ব্যবহারে বাংলা অনুবাদে সময়ক্ষেপণ; পঞ্চমত, আইনজীবীদের বাংলায় আবেদন করা ও শুনানিতে অনীহা।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ছাড়া আর কোনো বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় বা আদেশ লেখেন না। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে তিনি বর্তমানে যৌথভাবে বিচারকাজে নিয়োজিত আছেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ইংরেজিতে রায় ও আদেশ দিলেও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তার লিখিত রায় ও আদেশ বাংলায় লেখেন। বাংলায় লেখা তার উল্লেখযোগ্য রায়ের মধ্যে রয়েছে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা, এমভি নাছরিন-২ লঞ্চডুবি ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও সাজা, অর্থঋণ আদালত, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মামলা। এর আগে তিনি ২০১৩ সাল থেকে প্রায় এক বছর হাইকোর্টের একক দেওয়ানি মোশন বেঞ্চেরও দায়িত্বে ছিলেন। তখন তিনি প্রায় ৯০০ আদেশ ও রায় বাংলায় লিখেছিলেন বলে জানা গেছে।

বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল হাইকোর্টে নিয়োগ পান ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর। নিয়োগের পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে তিনি কয়েকটি মামলায় বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তবে গত ১৭ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের তৃতীয় বিচারক হিসেবে শুরু করে তিনি এখন নিয়মিতভাবে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে আসছেন। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বধীন যৌথ বেঞ্চে বিচারপতি আশরাফুল কামাল বর্তমানে বিচারকাজে নিয়োজিত আছেন।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৯০ দশক থেকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি (প্রয়াত) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন; কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল’ রিপোর্টার্স ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্যানুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন। তবে বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ স্থাপনা সংরক্ষণ, স্বাধীনতার ঘোষক, ঢাকার চার নদী রক্ষাসহ প্রায় দেড়শ’ উল্লেখযোগ্য মামলার রায় বাংলায় দেন। অবশ্য এর পর থেকে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার বিষয়টি এক প্রকার উপেক্ষিত।

হাইকোর্টে নিয়মিতভাবে দুই বিচারপতির বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা প্রসঙ্গে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘সংবিধান বলছে- বাংলা ভাষা সর্বস্তরে হবে। সেই ভরসাতেই বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করেছিলাম। এখনও কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় দিচ্ছেন। কিন্তু ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দ না থাকা ও সংশ্নিষ্টদের আগ্রহ না থাকায় উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় বা আদেশ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হচ্ছে না।’ তিনি জানান, আইন কমিশন থেকে আইন শব্দকোষ যুগোপযোগী করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০ হাজার বাংলা প্রতিশব্দ যুক্ত হয়েছে শব্দকোষের খসড়ায়। আশা করছি, এটি চূড়ান্ত হলে বাংলায় রায় ও আদেশ লেখার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

বাংলায় দুই বিচারপতির রায় ও আদেশ লেখার বিষয়টি স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, বাহাত্তরের মূল সংবিধানেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া বাংলায় রায় ও আদেশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বিচারপ্রার্থীরই সবচেয়ে বেশি। কারণ বাংলায় রায় দেওয়া হলে তাদের বোঝার জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তবে যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিশ্বের যেসব দেশের রায় ও আদেশ আমাদের এখানে নজির হিসেবে ব্যবহূত হয়, সেগুলো অনুবাদ করে বাংলায় রায় লেখা বেশ জটিল কাজ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে দায়িত্ব পালনকালে একাধিক উল্লেখযোগ্য রায় বাংলায় দিয়েছিলেন। প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি এখন নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে যাচ্ছেন। হাইকোর্টে দুই বিচারপতির বাংলায় রায় লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারকদের মানসিকতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতদূর জানি, ওই দুই বিচারপতিকে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দ না থাকায় তাদের রায় লিখতে কখনও কখনও অনেক সময়ও লাগছে। এ কারণে রায় ও আদেশ লেখায় অন্য বিচারকদের থেকে তারা পিছিয়েও পড়ছেন। তবে এ জন্য বাংলায় রায় ও আদেশ লেখাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আগে বিচারকরা খণ্ডিতভাবে অর্থাৎ কদাচিৎ বাংলায় রায় ও আদেশ দিতেন। এখন দুইজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন- এটি জেনে খুবই ভালো লাগছে। আশা করছি, আরও বেশি সংখ্যক বিচারক বাংলায় রায় ও আদেশ দিতে এগিয়ে আসবেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্‌দীন মালিক বলেন, আইনের শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি হলে বিচারপতিরা বাংলায় রায় বা আদেশ দিতে আগ্রহী হবেন।

হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, সংবিধান ও আইন অনুযায়ী উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের ইচ্ছা পূরণ হবে।

বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, দুইজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। এটি খুবই ইতিবাচক। ভবিষ্যতে তাদের পাশাপাশি আরও অনেক বিচারপতি বাংলায় লিখবেন। তবে ইংরেজিতে রায় ও আদেশ লেখারও প্রয়োজন রয়েছে। বহির্বিশ্বের বিচারাঙ্গনে আমাদের রায় যাতে ব্যবহূত হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন আমরা পিছিয়ে না থাকি।

বিচারপ্রার্থীদের প্রয়োজনে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে কি-না- এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মাতৃভাষার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। রায় ও আদেশ লেখার জন্য বিচারকরা কোন ভাষা ব্যবহার করবেন- সেটি নির্ধারণ করা তাদের মানসিকতা ও ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। এখানে আলাদা করে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। কোনো আদালত চাইলে রাষ্ট্রপক্ষ বাংলায় আবেদন জমা দেওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এদিকে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়ার ঘটনায় সংশ্নিষ্ট দুই বিচারপতির সঙ্গে কর্মরত সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা ধরনের ভোগান্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী গণমাধ্যমকে জানান, বিভাগীয় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে তাদেরকে বিধি অনুযায়ী পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ মহলে খোঁজ নিয়েও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। অবশ্য সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগের বিষয়টি জানা নেই বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার ও সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করা হবে। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া প্রসঙ্গে সাইফুর রহমান বলেন, কোন ভাষায় রায় বা আদেশ দেওয়া হবে- তা বিচারকের এখতিয়ার। সূত্র: সমকাল