মামলায় জর্জরিত তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে শতাধিক মামলার আসামি। কমপক্ষে ১০টিতে তার বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। দণ্ডিত হয়েছেন ২টিতে। এ ছাড়া একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটির বিচার শেষ পর্যায়ে। বাকি মামলাগুলোর মধ্যে কিছু বিচারাধীন আর কিছু তদন্তাধীন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া তার বক্তব্য প্রচারের ওপর রয়েছে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা। পাঁচটি মামলায় আত্মসমর্পণেরও আদেশ রয়েছে হাইকোর্টের।

জানা গেছে, বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। এর পর তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, আয়কর ফাঁকি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৫টি মামলা করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে কারামুক্ত হন। মুক্তির ৮ দিন পর ওই বছর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। এর পর থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন।

এ অবস্থায় পলাতক হিসেবে তারেক রহমান ২টি মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। বর্তমানে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি তারেক রহমান মামলার জালে বন্দি। বর্তমান সরকারের মেয়াদে দায়ের হওয়া শখানেক মামলার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগে দুটি ও অর্থপাচারের অভিযোগে করা মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। বাকি মামলাগুলো বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য মানহানির অভিযোগে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের হয়।

জানতে চাওয়া হলে তার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাকে সরকার বেশি ভয় পায়। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই সরকার একের পর এক মামলা করেছে। রাজনৈতিক বক্তব্যকে ইস্যু করে বিচারকদের ব্যবহারের মাধ্যমে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে। সব মামলায় মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। আমরা আইনগতভাবে এসব মামলা মোকাবিলা করব।’

দুই মামলায় দণ্ডিত: ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা পাচারের অভিযোগে তারেক রহমান ও তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর দুদক ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করে। ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোতাহার হোসেন এ মামলার রায়ে বেকসুর খালাস দেন। আর গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে দেওয়া হয় সাত বছর কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা জরিমানা। তারেকের রায়ের বিরুদ্ধে দুদক ওই বছর ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করে। হাইকোর্ট আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই তারেক রহমানের খালাসের রায় বাতিল করে ৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। একই সঙ্গে ২০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেন। পরবর্তী সময়ে রায়ের অনুলিপি নিম্নআদালতে আসার পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি দণ্ডিত হয়েছেন। ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের অভিযোগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। এই মামলায় তারেক রহমানসহ পাঁচজনকে ১০ বছর এবং তার মা খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এ মামলায় তারেক রহমান পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

চাঁদাবাজির মামলা : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তারেক রহমানকে ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরদিন থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, আয়কর ফাঁকি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে সে সময় অন্তত ১৫টি মামলা হয়। চাঁদাবাজির অভিযোগে দায়ের করা একটি ছাড়া প্রায় সব মামলায়ই তার বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রধান আসামি। পরে মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী তারেক রহমানকে আসামি করা হয়।

জানা যায়, ২০০৭ সালের ৮ মার্চ তারেক রহমান ও তার একান্ত সহকারী মিয়া নূরউদ্দিন অপুকে আসামি করে গুলশানের উদয় টাওয়ারের মালিক ও ঠিকাদার আমীন আহমেদ ভুঁইয়া ১ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেন। ওই বছরের ২৭ মার্চ রেজা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব উদ্দিন বাদী হয়ে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন। ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ গুলশান থানায় পঞ্চগড়ের মার্শাল ডিস্টিলারির স্বত্বাধিকারী হারুন ফেরদৌসী ৮০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেন। এতে তারেক রহমান ও তার বন্ধু মামুনসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল ব্যবসায়ী মীর জাহির হোসেন ধানম-ি থানায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তার ছয় সহযোগীর বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেন। একই বছরের ৯ এপ্রিল শাহবাগ থানায় আবদুল মোমেন লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক খায়রুল বাসার মামুনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেন। একই বছর ৪ মে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল আমিন কনস্ট্রাকশনের কর্মকর্তা সৈয়দ আবু শাহেদ সোহেল। মামলায় মামুন ও তার সহযোগীরা ৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। জাপান বাংলাদেশ গ্রুপের চেয়ারম্যান সেলিম প্রধানের কাছ থেকে যৌথভাবে কোম্পানি গড়ার নামে আট কোটি ৪০ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেন মামুন, এই অভিযোগে ২০০৭ এর ৫ জুন শাহবাগ থানায় মামুনের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করা হয়। এ ঘটনায়ও তারেকের ইন্ধন রয়েছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন মামুন। ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল কেরানীগঞ্জ থানায় গরু ব্যবসায়ী আদম আলীর কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগে তারেক ও মামুনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। ২০০৭ সালের মামুনের বিরুদ্ধে করা আরও তিনটি চাঁদাবাজির মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানো হয়।

এ ছাড়া অবৈধ উপার্জনের অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুদক ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় মামলা করে। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট ঢাকার বিশেষ আদালতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। এই মামলায় ২০০২-০৩ করবর্ষ থেকে ২০০৫-০৬ করবর্ষ পর্যন্ত এনবিআরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে ১ কোটি ৭ লাখ ৪৭ হাজার ১২৫ টাকার আয় গোপন করার অভিযোগ করা হয়। ওই টাকার ওপর নির্ধারিত ২৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮১ টাকা আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তা সাব্বির হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগেও তারেক রহমানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০০৭ সালের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় এ মামলা করা হয়। মামলাটিতে চার্জশিট হওয়ার পর বর্তমানে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও আয়করসংক্রান্ত পাঁচটি মামলার কার্যক্রম চলবে বলে রায় দেন হাইকোর্ট। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের হওয়া এসব মামলার ওপর এর আগে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ তুলে নেয় বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লা। আমাদের সময়