মাজহারুল ইসলাম

গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির পুন: পর্যালোচনা

মাজহারুল ইসলাম

বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ৫৪ টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, আর এ কারণে পানিবন্টন সমস্যা দু’দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাইহোক পানিবন্টন নিয়ে প্রধান দ্বন্দ্ব সমূহ হচ্ছে, গঙ্গা ও তিস্তা নদী পানিবন্টন, টিপাইমুখ বাঁধ যেটি মূলত করা হয়েছে বারাক নদীতে এবং ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদি। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ার কারণে পানির জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়, আর তা শুষ্ক মৌসুমে খরা এবং বর্ষা মৌসুমে বন্যার অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশ বারংবার দাবি করে আসছে যে, ভারত আন্তঃসীমান্ত নদী সমূহের পানি প্রবাহ পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদী সমূহের পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে বিপর্যস্ত করে আসছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী সমূহের পানিবণ্টন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ১৯৫১ সালে, যখন ভারত ফারাক্কা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং বাংলাদেশ যখন পশ্চিম  পাকিস্তানের অংশ ছিল।

পাকিস্তান ১৯৫১ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের বিরোধিতা করেছিল এবং ধারাবাহিকভাবে দু’দেশে এ  বিষয় নিয়ে তথ্যের আদান প্রদান করেছিল। পাকিস্তান ও ভারত ফারাক্কা বাঁধের বিষয়টি নিয়ে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসে, যেখানে দু’দেশ এ বিষয়টির উপর প্রচুর তথ্যের আদান-প্রদান করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে ভারত প্রথমবারের মতো গঙ্গাকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ভারতের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও  শান্তি’  চুক্তি নামে পরিচিত। এবং চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী ‘উভয় দেশ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আন্তঃসীমান্ত নদী সমূহের উন্নয়ন এবং জল বিদ্যুৎশক্তি ও সেচের উন্নয়নের যৌথকর্ম গ্রহণের জন্য সম্মত হয়’। এ চুক্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে ‘ইন্দো বাংলা যৌথ নদী কমিশন’ গঠিত হয় দুটি দেশের নদী ব্যবস্থা সমূহের উন্নয়ন ও নদী ব্যবস্থার ব্যাপক অধ্যায়নের জন্য। ভারত ফারাক্কা বাঁধ ১৯৭১  সালে  সম্পন্ন করে  এবং ১৯৭৫ সালে এর কার্যক্রম শুরু করে।

অপরদিকে ১৯৭৫ সালে ভারত ও বাংলাদেশ একটি সাময়িক পানি বরাদ্দ চুক্তি স্বাক্ষর করে যা শুধু মাত্র ৪১ দিনের জন্য কার্যকর ছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩১ তম অধিবেশনে বাংলাদেশ ফারাক্কা বিষয়টি উত্থাপন করে। অতঃপর ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ফলস্বরূপ পানিবন্টন চুক্তি হয় ১৯৭৭ সালে, কিন্তু দুঃখের বিষয় চুক্তিটি ছিল শুধু মাত্র ৫ বছরের জন্য। চুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল অনুচ্ছেদ ২ এটি  ‘ন্যূনতম গ্যারান্টি ক্লজ’  নামে পরিচিত যাতে বাংলাদেশকে একটি নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় যে, ‘শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৮০ ভাগ পানি পাবে। এবং অনুচ্ছেদ ১২ তে আরও দৃঢ় ভাবে উত্থাপিত হয় যে, চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পানির প্রবাহ যেকোনো পরিস্থিতিতেই কমানো যাবে না’।

১৯৭৭ সালের করা পানিবন্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়  ১৯৮২ সালে, তারপর দুই দেশ দুটি সমঝোতা স্মারক ১৯৮২ ও ১৯৮৫ স্বাক্ষর করে, কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় হলো এ দুটি সমঝোতা স্মারকে ‘ন্যূনতম গ্যারান্টি ক্লজ’  বিষয়টি বাদ দেয়া হয়। দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে এমন সমঝোতা স্মারক ইতিহাসে বিরল। ১৯৮৫ সালের সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষ হবার পর ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত, একটা দীর্ঘ সময় এ দু’দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের কোন প্রকার নীতিমালার ছিল না। এমনকি গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি ১৯৯৬ তেও ‘ন্যূনতম গ্যারান্টি ক্লজ’  অনুপস্থিত।

গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি ১৯৯৬ এর অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী ‘যদি পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেক এর নিচে থাকে টানা ১০ দিন ধরে, সে ক্ষেত্রে দু’দেশের সরকার অতি দ্রুত আলোচনায় বসবে এবং বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবে ন্যায্য নীতির ভিত্তিতে বা সুষ্ঠভাবে কোন পক্ষের ক্ষতি সাধন না করে’। অনুচ্ছেদ ৭ বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা অনুযায়ী,  ‘যৌথ কমিটি এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকবে। কোন প্রকার দ্বিমত বা বিরোধ যদি যৌথ কমিটি দ্বারা সমাধান না হয়, তবে  তা  ইন্দো-বাংলা নদী কমিশনের নিকট প্রেরণ করতে হবে। তারপরও যদি বিরোধ বা দ্বিমত অমীমাংসিত থাকে, তাহলে সেটা দু-সরকারকে অবহিত করতে হবে যা  তারা  পারস্পরিক আলোচনার দ্বারা সমাধান করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে’।

গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে, কারণ এটি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোন ‘সালিশি পক্রিয়া’ প্রদান করে নাই। যেখানে দুটি পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারত নেপাল এর সাথে ‘মহাকালি চুক্তি ১৯৯৬’  এবং পাকিস্তানের সাথে ‘সিন্ধু পানি চুক্তি ১৯৬০’  বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় ‘সালিশি পক্রিয়া’ বিদ্যমান।

প্রকৃতপক্ষে অনুচ্ছেদ ৯ গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি ১৯৯৬  অনুযায়ী ‘উভয় পক্ষের সমতা, ন্যায্যতা এবং সুষ্ঠভাবে কোন পক্ষের ক্ষতি সাধন না করে’ এ নীতিমালার ভিত্তিতে দুই দেশ বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ‘সমানুপাতিক পানি বণ্টনের’ এ তত্ত্বটি রোমান নীতি থেকে এসেছে যার অর্থ ‘আপনি আপনার নিজের ব্যবহার করেন অন্যের ক্ষতির সৃষ্টি না করে’। উপরন্তু, ‘সমানুপাতিক পানি বণ্টনের’ তত্ত্বটি অনুচ্ছেদ ৯ ও ১০ গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি  ১৯৯৬ এ দৃশ্যমান। এবং এই নীতিটি স্পষ্ট আকারে বিদ্যমান রয়েছে অনুচ্ছেদ ৫ থেকে ৭ জাতিসংঘ জলসম্পদ কনভেনশন ১৯৯৭ ও অনুচ্ছেদ ৪ থেকে ৮ হেলসিংকি বিধিতে। সুতরাং এই নীতিটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে, কিন্তু সমস্যা হল যে বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশই জাতিসংঘ জলসম্পদ কনভেনশন ১৯৯৭ (যে কনভেনশনটি ১৭ ই আগস্ট ২০১৪ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে) এর সদস্য নয়।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এই যে, এখন যদি চীন উজানের দেশ হিসেবে পানির প্রবাহকে নিজস্ব কাজে ব্যবহার করে, তাহলে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের জন্য এ অঞ্চলের জলপ্রবাহ অপর্যাপ্ত হয়ে উঠবে।এখনই উপযুক্ত সময় বহুপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কে সচল রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

অতএব, বাংলাদেশকে তিস্তা চুক্তি করতে ভারতের প্রতি কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির সমস্যা সমূহ সমাধান করতে হবে, আর এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ‘ন্যূনতম গ্যারান্টি ক্লজ’ এবং ‘সালিশি পক্রিয়া’ এবং তা করতে হবে অনুচ্ছেদ ১০ গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির ১৯৯৬  এর ‘পুনপর্যালোচনা পদ্ধতি’  অনুযায়ী এবং তা হতে হবে আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বজনীন গৃহীত আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে।

লেখক- পিএইচডি গবেষণারত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারতইমেইল: talukderlaw@gmail.com