একটি প্রেম, সমাজপতিদের অদূরদর্শিতা বনাম একটি নিষ্পাপ শিশু

সিরাজ প্রামাণিক: 

বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মাছুরা খাতুন (ছদ্মনাম) এর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিকে পা দিতেই তার সব অবয়বে ফুটে ওঠে বয়স বৃদ্ধির আলামত। নিজের মেধাগুণ ও সৌন্দর্য নিয়ে সে নিজেই একটা বিপত্তির মধ্যে পড়ে।

আশপাশের উঠতি বয়সী ছেলেরা তার ব্যাপারে একটু বেশি মনোযোগী হয়ে উঠে। মাছুরার কাছে অনাকাঙ্খিত এই মনোযোগ বিরক্তিকর মনে হলে একপর্যায়ে সে সুবোধ বালক সুমনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। আকর্ষণ থেকে গভীর ভালবাসার রুপ পরিগ্রহ করে। তাদের অভিসারকে বাস্তবে চিত্রায়িত করতে একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিধিবাম! বাঁধ সাধে মা-বাবা, অভিভাবক ও কথিত সমাজপতিরা। সব বাঁধা অতিক্রম করে তারা দু’জন একই বৃন্তে ফোটার শেষ প্রান্তে ঘটে আরেক নাটকীয়তা। মাছুরাকে থামিয়ে দেওয়া হয় সুমনের সঙ্গে সম্পর্ক। মেয়ের সুখ-শান্তির বিষয় বিবেচনা করে মাছুরার পরিবার বিয়ের আয়োজন করে সরকারী চাকুরে সুজিতের সঙ্গে। মাছুরার জীবনে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়।

সাংসারিক সচ্ছলতা এবং স্বামী ও শ্বশুরকুলের ভালবাসার কমতি না থাকলেও মাছুরার মনে সুমনের স্মৃতি হৃদয়ের ক্যানভাসে ভাসতে থাকে। এদিকে ব্যর্থ প্রেমিক সুমন বুকে হাজারো কষ্ট নিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে জুটিয়ে নেয় একটি চাকুরী। দেখতে দেখতে কেটে যায় একটি বছর। বিদ্যোৎসাহী স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাছুরা কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। দেখা হয় সুমনের সাথে। মাছুরা পুরনো স্মৃতিময় দিনে ফিরে যান তাঁর কল্পজগতে। সত্যি মাছুরা চলে যায় সুমনের হাত ধরে। প্রেমিক জুটির এ অভিসার গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ব্যাপক সাড়া জাগায়। কৌতূহলী মানুষের আলোচনার খোরাক হয়ে যায় এ ঘটনা। থানায় ‘জিডি’ করেন মাছুরার স্বামী। চলতে থাকে মাছুরার সন্ধান। খবর পৌঁছে যায় মাছুরা-সুমন জুটির কানে। পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে প্রেমিক জুটি ঘন ঘন অবস্থান বদল করতে থাকেন।

এদিকে মাছুরাকে উদ্ধারের জন্য স্বামী সুজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জারি করেন ‘সার্চ ওয়ারেন্ট যা বাংলায় তল্লাশি পরোয়ানা’ নামে পরিচিত। বে-আইনীভাবে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য তল্লাসি ওয়ারেন্টের বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০০ ধারায় বলা হয়েছে যে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এরুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে-যা রীতিরকম অপরাধের সামিল, তাহলে তিনি একটি তল্লাসি ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবেন। এদিকে পেরিয়ে গেছে প্রায় দু’মাস। মাছুরাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে থানা পুলিশ। কিন্তু মাছুরা অন্তঃসত্ত্বা। রুজু হয় নিয়মিত মামলা।

ধর্মীয় অনুযায়ী অপরের বিবাহিতা স্ত্রী তার স্বামীত্বে থাকতে আর অন্য পুরুষের জন্য বৈধ নয়। সে মারা গিয়ে অথবা তালাক দিয়ে ইদ্দতের যথা সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ রমণীকে বিবাহ করা হারাম। সুতরাং ঐ মহিলা আসলে গম্যা, কিন্তু অপরের স্বামীত্বে থাকার জন্য সাময়িকভাবে অন্যের পক্ষে অবৈধ। এমন বিবাহিত সধবাকে কেউ বিয়ে করলেও বিবাহ-বন্ধনই হয় না। সে প্রথম স্বামীরই অধিকারভুক্ত থাকে, আর দ্বিতীয় স্বামী ব্যভিচারী হয়। (সূরা আন-নিসা)

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারায় বলা অছে, স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পূনরায় বিবাহ করা। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে যে প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, বিয়ের সময় পর্যন্ত সে স্বামী বা স্ত্রী যদি সাত বছর পর্যন্ত নিখোঁজ থাকেন এবং সেই ব্যক্তি বেঁচে আছেন বলে কোনো সংবাদ না পান, তাহলে এ ধারার আওতায় তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবেন না। জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ।

প্রেমিক জুটি মাছুরা-সুমনের মামলা চলছে বিচারিক আদালতে। পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে দ-বিধির ৪৯৪ ধারায় চার্জশীট দাখিল করলেন। চার্জশীটে মাছুরার সঙ্গে সুজিতের বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল থাকা অবস্থায় তাঁকে সুমন বিয়ে করেছেন বলে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বিচারিক আদালতের বিচারক মহোদয় প্রেমিক জুটির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেন। তাঁরা উভয়েই নিজেদের নির্দোষ দাবী করে আদালতের কাছে বিচার প্রার্থনা করলেন। আদালতে দুটি বিবাহের কাবিননামার সার্টিফাই কপি দাখিল করলেন প্রসিকিউশন পক্ষ। দালিলিক প্রমাণ খ-ানোর উপায় নেই। সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে বিচারক মাছুরা-সুমন উভয়কেই দোষী সাব্যস্ত করে সুমনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- ও মাছুরাকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড তৎসহ উভয়কেই জরিমানা সাজা দেন।

আসামীপক্ষের আইনজীবী এ সাজার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ ধারামতে উচ্চ আদালতে আপীল দায়েরের শর্তে জামিনের প্রার্থনা আনয়ন করলেন। অন্তঃসত্ত্বা নারী বিবেচনায় শুধুমাত্র মাছুরার জামিনের প্রার্থনা বিজ্ঞ আদালত মঞ্জুর করলেন। এরই মধ্যে মাছুরা সন্তান প্রসব করেছেন, যা সমুনের ঔরষজাত সন্তান। শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েই প্রতিটি ধার্য তারিখে আদালতে হাজির হন মাছুরা। উল্লেখ্য, দ-িত করার সময় সার্বিক মানবিক দিক বিবেচনা করে বিচারক মহোদয় মাছুরার প্রতি নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

আপিল আদালত এক পর্যায়ে সুমনকে জামিনে মুক্তি দেন। কিন্তু বিধিবাম! আগের স্বামী সুজিত তাঁকে তালাক দিতে অস্বীকার করেন। মাছুরা হয় অনুতপ্ত। সুজিতের বিশ্বাস মানুষ ভুল করতে পারে, তাই বলে সে অস্পৃশ্য হয়ে যায় না। তাঁর আত্মোপলব্ধি ও অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ আছে। এই আত্মোপলব্ধি ও অনুতাপের ফলে মানুষ লাভ করে মহত্ত্ব। এই পরম বিশ্বাসেই মাছুরাকে ঘরে নিয়ে যান তার বৈধ স্বামী সুজিত। প্রেমিক সুমনের ঔরষজাত সন্তানকে তাঁর নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিতে সুজিত মোটেই আপত্তি করেনি। এরপরও ওই সন্তানের লালনপালনের ভার গ্রহণ করে মাছুরার মা-বাবা। এত কিছুর পরও ওই শিশুর পিতৃ-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ সুমন তো মাছুরার বৈধ স্বামী ছিলেন না।

মাছুরার প্রথম জীবনের ভালবাসাকে মূল্যায়ন না করা, সমাজপতিদের অদূরদর্শিতা অন্যদিকে তাঁকে পরামর্শ ও প্রশ্রয় দাতাদের ভুলের কারণে সৃষ্টি হয় একটি সামাজিক সংকট। যার গ্লানি ওই নিষ্পাপ শিশুকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনান্তর। আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিবাহবর্হিভূত সন্তান জন্ম নেয়াকে ‘পাপের ফল’ বলে অভিহিত করা হয়। সমাজের সে ছুতো ধরে নিষ্পাপ এ শিশুটিকে পাপের বোঝা মাথায় নিয়েই জীবন-জগৎকে দেখতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।