সাঈদ আহসান খালিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

আইনজীবী তালিকাভুক্তিতে পরীক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করা উচিৎ

 

‣ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা অনতিবিলম্ব তুলে দেওয়া উচিত। প্রিলি-লিখিত-ভাইভা এই তিন স্তর বিশিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতির জটিলতা, বছরে মাত্র একবার পরীক্ষা গ্রহণ করে সেটির চূড়ান্ত ফলপ্রকাশে মাসের পর মাস এমনকি বছর পেরোনো অপেক্ষা ও দীর্ঘসূত্রিতা বার কাউন্সিলের চরম দায়িত্বহীন কাজ ও কর্তব্য অবহেলার দৃষ্টান্ত। হাজার হাজার আইনের গ্র্যাজুয়েটদের আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন এই তালিকাভুক্তির গ্যাঁড়াকলে পড়ে খুন হচ্ছে, ৬ মাসের শিক্ষানবিশ কাল প্রলম্বিত হতে হতে অনেকের জন্য অনন্তকালের রূপ নিয়েছে, নিচ্ছে। এটি অন্যায়।

‣ আইনপেশা ছাড়া আর কোন বিশেষায়িত পেশায় এই “তালিকাভুক্তি পরীক্ষা” নামক সিস্টেমের অস্তিত্ব নাই। আইনও এমবিবিএস, বিডিএস, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসি ইত্যাদি বিষয়ের মতো একটি হাইলি স্পেশালাইজড ও প্রফেশনাল সাবজেক্ট। একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন শেষে বাংলাদেশে এমবিবিএস বা বিডিএস গ্র্যাজুয়েটরা কোন ‘তালিকাভুক্তি পরীক্ষা’ ব্যতিরেকে ‘Bangladesh Medical & Dental Council (BM&DC)’ এর অধীনে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করে নিবন্ধিত হয়ে রেজিস্টার্ড ডাক্তার বা ডেন্টিস্ট হিসেবে পেশাজীবন শুরু করে।

একইভাবে যারা ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স এর উপর ডিগ্রি অর্জন করে তাদের কোন ‘তালিকাভুক্তি পরীক্ষা’র সম্মুখীন হতে হয়না। Bangladesh Veterinary Council এ আবেদন করে ভেটেরিনারি প্র্যাকটিশনার হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে পেশাজীবন শুরু করে।

ফার্মাসি বিষয়ে একাডেমিক ডিগ্রি নিয়ে যারা ফার্মাসিস্ট হিসেবে পেশা শুরু করে তাদেরও কোন ‘তালিকাভুক্তি পরীক্ষা’ দিতে হয়না, পূর্বোক্ত পেশাজীবীদের মতোই ‘Pharmacy Council of Bangladesh’ এর অধীনে নিবন্ধন সেরে পেশাজীবন শুরু করে।

‣ এলএল. বি. ডিগ্রি অর্জনের পরে আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতার শর্ত হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিনিয়র এডভোকেটের অধীনে ৬ মাসের ইন্টার্নিশিপ বা পিউপিলেজ সিস্টেম বাতিল করা উচিত। পূর্বোক্ত সমস্ত ডিসিপ্লিনে এই ইন্টার্নিশিপ তাদের একাডেমিক ডিগ্রির শর্ত; পেশায় তালিকাভুক্তি পরীক্ষার শর্ত নয়। এমনকি বিবিএ ডিগ্রিতেও ইন্টার্নশিপ একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের সাথে সম্পৃক্ত; পেশাজীবনের সাথে নয়।

আইনের একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের পরেও এই ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা সদ্য এলএল.বি. (অনার্স) পাশ করা গ্র্যাজুয়েটদের নিদারুণ বিড়ম্বনার সম্মুখীন করে। এত এত আইনের গ্র‍্যাজুয়েট কর্তৃক ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সিনিয়র এডভোকেট ম্যানেজ করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ছোট একটি চেম্বারে একজন সিনিয়র কয়জন শিক্ষানবিশকে একোমোডেট করতে পারে? অনার্স শেষ করার সাথে সাথেই এলএল.এম. ডিগ্রির ক্লাস শুরু হয়ে যায়, বেশিরভাগ আইনের গ্র্যাজুয়েটই কাগজে কলমে ইন্টার্নশিপ করে; এলএল.এম. ডিগ্রি অর্জন কিংবা আইনজীবী হওয়ার আগে বাস্তবে আর তাদের কোর্টে যাওয়া হয়না।

এই ইন্টার্নশিপ বা আদালতে সিনিয়র এডভোকেটের অধীনে ৬ মাসের পিউপিলেজকে অন্যান্য বিশেষায়িত ডিগ্রির মতোই এলএল.বি. (অনার্স) ফাইনাল ইয়ারে সংযুক্ত করা উচিত। এই ৬ মাস শিক্ষার্থীরা সিনিয়র এডভোকেটের অধীনে আদালতে সংযুক্ত থাকবে। এক্ষেত্রে সিনিয়রের ১০ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করতে হবে। ৬ মাসের পিউপিলেজ শেষে কেস রিপোর্ট সাবমিশন করে বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সে আইনের গ্র‍্যাজুয়েশন লাভ করবে এবং এদের মধ্যে যারা ল প্র্যাকটিস করতে চায় তারা বার কাউন্সিলে আবেদন করে নিবন্ধিত হয়ে এডভোকেট হিসেবে পেশাজীবন শুরু করবে।

‣ আইনজীবী হিসেবে সরাসরি নিবন্ধিত হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনের ডিগ্রির গুণগত মান নিশ্চিত করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এর উদ্যোগ এখানে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এখন প্রতি সেমিস্টারে ৫০ জন এর বেশি আইনের শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায়না। এটি আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রেডিং সিস্টেম অভিন্ন হয়েছে- এটিও কার্যকরী পদক্ষেপ। সবচেয়ে ভাল হয় এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রির প্রফেশনাল পরীক্ষা (প্রফ) এর মতো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা ও একই সময়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রদান করার যদি ব্যবস্থা হয়। তখন পাশ করা আইনের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে যারা এডভোকেট হতে চায় তারা সবাই একই সময়ে তালিকাভুক্ত হতে পারবে।

‣ নতুন তালিকাভুক্ত আইনজীবীদের জন্য প্রথম ১/২ বছর সিনিয়র এডভোকেটের অধীনে ‘প্রবেশনারি এডভোকেট’ হিসেবে কাজ করার শর্ত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রবেশনারি পিরিয়ডে তাঁকে ‘সম্মানজনক সম্মানি’ ও আনুষঙ্গিক আর্থিক সুবিধার আইনগত ব্যবস্থা করতে হবে।

যতদিন আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার পূর্বশর্ত এই হয়রানিমূলক ইন্টার্নশিপ এবং এডভোকেট তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নামক দীর্ঘ পুলসিরাতের অবসান না হচ্ছে শিক্ষানবিশ আইনজীবী নামের রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের ‘ফটিক’দের দু:খ দুর্দশা ও বিড়ম্বনার শেষ হবেনা।

‣ আইনজীবীদের নিজেদের দাবি- অধিকার আদায়ে বাংলাদেশে জেলা ভিত্তিক বার এসোসিয়েশন আছে, নানান ঘরানার সমন্বয়ে কিংবা সমমনাদের নিয়ে আইনজীবী সংগঠন আছে; ইন্টার্ন ডাক্তারদের এসোসিয়েশন আছে, প্রকৌশলীদের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন আছে, সব পেশাজীবীদেরই পেশাভিত্তিক সংগঠন আছে কিন্তু দু:খজনকভাবে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সুবিধা- অসুবিধা, অধিকার- কর্তব্য, একতা, শৃঙ্খলা দেখভালের জন্য কোন এসোসিয়েশন নাই। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের একতাবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি।

আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করার বর্তমান প্রক্রিয়াকে এমন দুর্গম, দুস্তর, দু:সাধ্য, দু:সহ করে রাখার মাধ্যমে আমাদের আদালতগুলো মেধাবী, স্বপ্নবাজ ও উদ্যমী তরুণ আইনজীবীর সেবা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ডাক্তার পাশ করার পর প্র‍্যাকটিস করে, অন্যকিছু করলে সবাই চোখ কপালে তুলে এবং এটিকে তুমুল ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখা হয়, ডেন্টিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার ওদের ক্ষেত্রেও তাই। আইন পড়ে আইনজীবী হিসেবে আইন প্র‍্যাকটিস করবে- এটাই তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা, কিন্তু শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আইনের গ্র‍্যাজুয়েট কেন আইন প্র্যাকটিস করে না, কেন প্র‍্যাকটিস শুরু করেও টিকতে পারেনা- এই প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মানুষেরা কি কখনো খুঁজবেনা? আর কতোদিন আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রেখে ‘প্রলয় বন্ধ আছে’ – এই মিথ্যে সান্ত্বনার আশ্রয় নেব?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ -এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত