অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান

আইনজীবীদের স্বার্থে বার কাউন্সিল সমীপে কতিপয় সুপারিশ

 

মোহাম্মদ মশিউর রহমান:

রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। বিচার বিভাগের হাত দুটি হলে- একটি বিচারক, অন্যটি আইনজীবী। দেশের সকল আইনজীবীদের তালিকাভুক্তিসহ তাদের পেশাগত শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। অন্যদিক থেকে ভাবলে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের অধিকাংশ বিচারপতি নিয়োগ হয়ে থাকে আইনজীবীদের মধ্য থেকে। এমনকি বিচারিক আদালতের অধিকাংশ বিচারকেরও আইনজীবী সনদ রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই পেশাশুরু করেছেন আইনজীবী হিসেবে। কিছু সংখ্যক বিচারক এর ব্যতিক্রম হতে পারেন। সে কারণে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল শুধুমাত্র আইনজীবীদের তালিকাভুক্তিতে সীমিত নয়। সামগ্রিক বিচার বিভাগের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। সঙ্গত কারণেই সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মূল কাজ দু’টি। আইনজীবিদের তালিকাভুক্তি তথা সনদ প্রদান ও তাদের পেশাগত শৃঙ্খলা দেখভাল করা। তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ যতটা, পেশাগত শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ততটা নয়। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের জন্ম হলেও গত ৪৬ বছরে এ প্রতিষ্ঠানের খুব বেশী আধুনিকায়ন হয়নি। আইনজীবীদের তালিকাভুক্তি পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে অকাট্য সমালোচনা। অন্যদিকে আইনজীবিদের পেশাগত শৃঙ্খলা বিধানে প্রতিষ্ঠানটি প্রায়ই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে। সে কারণে বাংলাদেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র সীমিত হচ্ছে বলে মনে করা হয়। এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে প্রতিষ্ঠানটির আধুনিকায়ন, দেশের সামগ্রিক সুশাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে কিছু ব্যক্তিগত সুপারিশ তুলে ধরছি:

আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা
আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি পরিক্ষার পদ্ধতি, এর সময়সূচি, সিলেবাস, প্রশ্নপত্রের ধরণ ও ফল প্রকাশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বিদ্যমান অসন্তোষ দূর করতে হবে। প্রতি বছর অন্তত একবার পরীক্ষা আয়োজন করা (বর্তমানে চালুকৃত এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিকসহ) এবং বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তার ফল প্রকাশ করতে হবে। পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে পুস্তকনির্ভরতা কমাতে হবে। শুধুমাত্র আইনের ধারা মনে রাখার প্রবণতা তৈরী না করে আইনের মর্ম বুঝতে শিখা ও তার প্রায়েগিক শিক্ষার দিকে নতুনদের ধাবিত করার মত উপযুক্ত প্রশ্নপত্র ও সিলেবাস ঠিক করতে হবে। সেক্ষেত্রে আরো অধিক সংখ্যক অভিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারকদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

হাইকোর্ট বিভাগের লিখিত পরীক্ষা শুধুমাত্র মুসাবিধা নির্ভর। অথচ মুসাবিধা আইনপেশার একটি দিক মাত্র এবং আইনের মৌলিক জ্ঞান ব্যতীত মুসাবিধা কোনভাবেই সমৃদ্ধ হতে পারে না। এক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে আইনের মৌলিক জ্ঞান ও এর প্রায়োগিক দিক ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর (এসএকিউ) কিংবা সমস্যা-সমাধান (প্রবলেম সলভ) সিলেবাসে যোগ করা যেতে পারে। এ এক্ষেত্রেও প্রতি বছর অন্তত একবার পরীক্ষা আয়োজন করা এবং বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তার আয়োজন ও ফল প্রকাশ করতে হবে।

প্রশিক্ষণ
আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনমাসব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তা অজানা কারনে বন্ধ হয়ে যায়। তালিকাভুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে অন্তত ৬ মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগে তালিকাভুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবেও নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষণের বিধান থাকতে পারে। এমনকি পেশাগত জীবনে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে। পেশাগত জীবনে কাজের ধরণ ভেদে (প্রধানত দেওয়ানী ও ফৌজদারী) প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদান করা যেতে পারে।

পেশাগত নৈতিকতা
আইনজীবীদের পেশার মানদন্ড নির্ধারণে নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বার কাউন্সিলের নৈতিকতা বিষয়ক ‘ক্যানন অব প্রফেসনাল কনডাক্ট ও ইটিক্যাট’ থাকলেও তা পেশা কিংবা বাস্তবের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে এসকল আচরণ বিধি প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই। আইন পেশার ধরণ ভেদে বিধি তৈরী করে তার প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে হবে। অন্যদিকে তালিকাভুক্তির পর যারা অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন তাদের জন্যও আলাদা বিধি তৈরী করা যেতে পারে। দেশের সকল বিচারিক আদালতে বিচারাধীন মামলায় আইনজীবী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘অনাপত্তিপত্র’ বাধ্যতামূলক করা জরুরী।

পেশাগত শৃঙ্খলা
তালিকাভুক্তির পর কোন আইনজীবী আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন আর কারা অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন তার তথ্য নিশ্চিত করতে হবে এবং সহযোগী আইনজীবীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আইন পেশায় নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে কে কোন বারে (আইনজীবী সমিতি) কাজ করছেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করছেন নাকি সিনিয়রের সাথে কাজ করছেন তা জানতে হবে। কতদিনের অভিজ্ঞতা থাকলে চেম্বার করতে পারবে কিংবা একজন নতুন আইনজীবীকে সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে তার নিয়ম করতে হবে। সেক্ষেত্রে চেম্বার পরিচালনা, সহযোগী আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে কাউন্সিল অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রত্যেক আইনজীবীকে তার কাজের ঠিকানা ও ধরণ, চেম্বারের ঠিকানা ও সহযোগী আইনজীবীদের তথ্য হালনাগাদ করতে হবে। চেম্বারে কাজ বন্টণ, মাসিক ন্যূনতম সম্মানী প্রদান ও চেম্বার পরিচালনায় সর্বোপরি কোন অনিয়ম হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে বার কাউন্সিল বিধি তৈরী করতে পারে। একইভাবে তালিকাভুক্ত কোন আইনজীবী অন্য কোন পেশায় যোগ দিয়ে থাকলে তার হালনাগাদ তথ্য থাকতে হবে। কেউ প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকলে, রাজনীতিতে পদ লাভ করলে কিংবা বিদেশে অবস্থান করলে তার হালনাগাদ তথ্য থাকতে হবে। সহযোগী আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সম্মানীর বিধান থাকতে হবে। সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ প্রদানের বিধান করা যেতে পারে।

কোন আইনজীবীর ফৌজদারী রেকর্ড আছে কিনা, বিচারাধীন কোন মামলার পক্ষ কিনা, ব্যাংকিং দায় আছে কিনা, বার কাউন্সিল বা বার সমিতি কর্তৃক কোন কারণ দর্শানো কিংবা শাস্তি হয়েছে কিনা এ সকল বিষয় বার কাউন্সিল তদারকি করতে পারে। কোন আইনজীবীর কোন প্রকাশনা, সম্মাননা, পুরস্কার কিংবা বৃত্তি থাকলে তারও রেকর্ড রাখতে হবে। বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইট সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। এসকল কাজগুলো অবশ্যই অনলাইনে জমা দেয়ার বিধান থাকতে হবে এবং প্রত্যেকের জন্য তার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

বার কাউন্সিলকে যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবী তৈরীর দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ এটি কোন চাকুরী নয়। এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পেশা। এখানে টিকে থাকতে হলে যোগ্যতা দরকার। শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহ মূল উদ্দেশ্য হলে চলবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এ পেশার মূল লক্ষ্য। যোগ্যদের মাধ্যমেই কেবল পেশায় টিকে থাকা এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী