ইয়াবা-অস্ত্র উদ্ধারের সাজানো মামলায় শিক্ষানবীশ আইনজীবীকে ফাঁসানোর অভিযোগ

চট্টগ্রামে সমর কৃষ্ণ চৌধুরী (৬০) নামে এক শিক্ষানবীশ আইনজীবীকে ইয়াবা ও অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম আদালত অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশের এমন কাজে বিস্মিত, বিরক্ত আইনজীবীরা।

এদিকে, আজ বুধবার (৩০ মে) চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-২ মোহম্মদ হেলাল উদ্দীনের আদালতে সমর কৃষ্ণ চৌধুরীর জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

সমর কৃষ্ণের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, সমিতির সিনিয়র সদস্য অ্যাড রনাঙ্গ বিকাশ চৌধুরী, সমিতির সাবেক সাধারন সম্পদক অ্যাড. আব্দুর রশীদ এবং সমীর কৃষ্ণ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের সময়ে প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী অ্যাড.জুয়েল দাশ, অ্যাড. গৌতম চৌধুরী পার্থ, অ্যাড.আরশাদুর রহমান রিটু জামিন শুনানীতে অংশ নেন। এছাড়াও বিপুল সংখ্যক আইনজীবী জামিন শুনানীতে সমীর কৃষ্ণ চৌধুরীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন। যদিও আদালত শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।

জানা যায়, চট্টগ্রাম জজ কোর্টের তিনজন আইনজীবী অ্যাড. জুয়েল দাশ, অ্যাড. গৌতম চৌধুরী পার্থ, অ্যাড.আরশাদুর রহমান রিটু এবং শিক্ষানবীশ আইনজীবী সমর কৃষ্ণ চৌধুরীসহ গত রোববার (২৭ মে) চট্টগ্রাম কোর্ট হিল থেকে সন্ধ্যা ৭টায় নেমে জহুর হকার্স মার্কেটের মুখে রাস্তায় এসে যে যার গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিক্সা/সিএনজি উঠে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। হঠাৎ করে সমর কৃষ্ণ চৌধুরীকে বোয়ালখালী থানার এসআই পরিচয়দানকারী এক পুলিশের সঙ্গীয় ফোর্স টানাহেঁচড়া করে একটি মাইক্রবাসে তুলে নিয়ে যায়। তখন উপস্থিত আইনজীবী অ্যাড জুয়েল দাশ পুলিশের কাছে কোন ওয়ারেন্ট বা মামলার কপি আছে কি-না জানতে চায়। পরে সব জানতে পারবে বলে পুলিশ মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যায়।

রাতে সমর কৃষ্ণ চৌধুরী কে নিয়ে পুলিশ অভিযানে নেমে তারঁ গ্রামের বাড়ীতে যান। তালাবদ্ধ ঘরের দরজা ভেঙ্গে বিছানার চাদরের নীচ থেকে ৩১০ পিস ইয়াবা আর খাটের নীচ থেকে ১টি দেশীয় অস্ত্র, ৪টি গুলি উদ্ধার করেছে বলে দাবী পুলিশের।

বোয়ালখালীতে জমি নিয়ে বিরোধে জড়িত একজন প্রবাসীর পক্ষ নিয়ে এটি পুলিশের সাজানো ঘটনা বলে অভিযোগ করেছেন সমর চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা।

গতকাল মঙ্গলবার এ নিয়ে মানববন্ধন, মিছিল–মিটিং, পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা–ধাওয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাদ–প্রতিবাদে উত্তাল ছিল বোয়ালখালী। তবে পুলিশ বলছে, ইতোপূর্বে দায়েরকৃত মাদকের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয় এবং ১টি এলজি ও ৩১০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

অন্যদিকে সমর চৌধুরীর মেয়ে অলকানন্দা চৌধুরী গতকাল বিকালে বোয়ালখালীতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি অভিযোগ করেন, গত ২৭ মে নগরীর জহুর হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে তার পিতা সমর চৌধুরীকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। রাতভর বোয়ালখালী থানায় আটকে রাখে। পর দিন বাবাকে নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে যায়। সেখানে অস্ত্র ও ইয়াবা দিয়ে ছবি তোলে। পরে অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেয়।

তিনি অভিযোগে আরো বলেন, বাবাকে আটকের পর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছি। পরে বোয়ালখালী থানায় গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিমাংশু কুমার দাস আমার বাবাকে গ্রেপ্তারে ‘উপরের নির্দেশ’ রয়েছে বলে জানান। কার নির্দেশ? কেন নিরীহ ব্যক্তিকে এভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন? জানতে চাইলে ওসি এর কোনো সদুত্তর দেননি।

অলকানন্দা আরও বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সঞ্জয় দাশের সঙ্গে আমার বাবার বন্ধু স্বপন দাশের জায়গা সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ চলছে। এ নিয়ে স্বপন দাশ আমার বাবার সহায়তা চাইলে তিনি একজন ভালো আইনজীবী দেখিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সঞ্জয় দাশ পুলিশকে দিয়ে আমার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। এর আগেও বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

গতকাল (২৯ মে) আদালতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন, মাইক্রোবাসে তুলে পুলিশ সদস্যরা কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে তাকে চরণদ্বীপ খালের পাশে নিয়ে যায়। মাইক্রোবাসে পুলিশ সদস্যদের কথোপকথন থেকে তিনি বুঝতে পারেন তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওখানে যাওয়া মাত্র পুলিশের কাছে দুই-তিনটি ফোন আসে। এরপর পুলিশ ওখান থেকে মাইক্রোবাস ঘুরিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে ঘরে আগে থেকে রেখে দেওয়া অস্ত্র ও ইয়াবা দিয়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।’

ব্রিটিশ নাগরিকের পক্ষ নিয়ে পুলিশ এ ঘটনা সাজিয়েছে বলে যে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বোয়ালখালী থানার ওসি হিমাংশু কুমার দাস বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা কখনো তার বিপক্ষে বলবে না। শুধু মাদক মামলার কথা বলছি কেন, তার নামে তো হত্যা মামলাও ছিল এর আগে। পরে বোধহয় তিনি খালাস পেয়েছেন ওই মামলায়। আমার কাছে ডকুমেন্ট নেই। আমি শুনেছি।’

সমর চৌধুরীর বিষয়ে জানতে চাইলে সারোয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বলেন, ‘সমর চৌধুরী এলাকায় থাকেন না। তবে আমরা তাকে যতটুকু জানি, সে এ ধরনের কাজে জড়িত থাকতে পারে না। তাকে কখনও সিগারেট খেতেও দেখিনি।’

পুলিশের এ দাবি মানতে নারাজ এলাকাবাসী। তাদের দাবি, লোভের বশবর্তী হয়ে পুলিশ তাদের এক প্রভাবশালী প্রতিবেশীর ইশারায় সমর চৌধুরীর মতো একজন সহজ–সরল বয়স্ক মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে নগরী থেকে জোরপূর্বক তুলে এনে বোয়ালখালীর তার পরিত্যক্ত বাড়িতে অস্ত্র ও ইয়াবা দিয়ে আটক করেছে; যা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই প্রতিবাদে এলাকাবাসী মাঠে নামে। এ নিয়ে গতকাল এলাকাবাসী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ করে। পরে সমর চৌধুরীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করতে চাইলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ২ জনকে আটক করে। বিকালে এ নিয়ে উপজেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করার সময় পুলিশ প্রেস ক্লাব ঘিরে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে।

রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী/চট্টগ্রাম প্রতিনিধি