ঢাকার অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কেশব রায় চৌধুরী

ম্যাজিস্ট্রেটকে হাকিম বললে ভাব নিগূঢ় হয় না, বোধেও তৃপ্তি আসে না

কেশব রায় চৌধুরী:

‘ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দটির প্রতি যেমন আমার বিশেষ কোনো অনুরাগ নেই, তেমনি ‘হাকিম’ শব্দটির প্রতি আমার তেমন কোনো গাত্রদাহ নেই। তবে বোধগম্যতার সুবিধা-অসুবিধা এবং শুদ্ধাচারের প্রশ্নেই শব্দ দুটির ব্যবহার নিয়ে আমার এই বিতর্কের অবতারণা।

শত শত নিত্যপ্রচলিত বিদেশি শব্দ বাংলায় এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, কোনো বাংলা প্রতিশব্দ দিয়ে এগুলোর তর্জমা করতে গেলে কিছুতেই খাপ খায় না। তাদের ঠিক প্রতিশব্দও বাংলায় নেই। ‘Magistrate’ শব্দটিও এমনই একটি শব্দ, যার কোনো প্রতিশব্দ বাংলায় নেই।

রোমান ‘Magistratus’ থেকে ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থায় ‘Magistrate’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি। অতঃপর ব্রিটিশ শাসনের বদৌলতে এই উপমহাদেশের বিচার ব্যবস্থায় শব্দটির আগমন। পরবর্তীকালে আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে শব্দটি নিত্যপ্রচলিত শব্দ হয়ে বাংলা অভিধানে ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ বানানরূপে ‘ফৌজদারি মোকদ্দমার বিচারক’ অর্থে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে, এখন আর কেউ শব্দটির প্রতিশব্দ হাতড়ে বেড়ায় না।

রোমান ল কিংবা কমন ল, এমনকি অভিধানিক তর্জমায়ও ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি দিয়ে ছোটোখাটো ফৌজদারি মামলার বিচারককেই বুঝানো হয়েছে। এর আর ভিন্ন কোনো অর্থ বা তর্জমা কোথাও নেই। আমাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডেও পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডযোগ্য ফৌজদারি মামলা বিচারের এবং প্রায় সকল ফৌজদারি মামলা বিচারের প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরের বিচারককেই ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়েছে। সাধারণ জনগণও ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি বলতে চট করে এখন তাই বুঝতে অভ্যস্ত-প্রায়।

ভাষার সমৃদ্ধি ও ভাবের লাগসই প্রকাশের জন্য ইংরেজি ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দু ও হিন্দি প্রভৃতি বহুভাষার শব্দ আত্তীকৃত করে নিয়েছে বাংলা ভাষা। তেমনই একটি শব্দ ‘হাকিম’, যা আরবি ভাষা থেকে নেওয়া। বাংলা অভিধানে এই ‘হাকিম’ শব্দটির চারটি প্রতিশব্দ আছে; যথা: ১। বিচারক, ২। বিজ্ঞ বা জ্ঞানী, ৩। ইউনানি চিকিৎসক ও ৪। শাসনকর্তা। অর্থাৎ হাকিম বলতে অন্য তিনটি অর্থের সাথে বিচারককেও বুঝানো হয়েছে। কিন্তু বিচারক শব্দটি দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলার বিচারকের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি উচ্চ কিংবা অধঃস্তন আদালতের বিচারকের ক্ষেত্রেও শব্দটি গড়পড়তাভাবেই ব্যবহৃত হয়; ঠিক যেমন ইংরেজি ‘Judge’ বা বাংলায় আত্তীকৃত ‘জজ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় সকল বিচারকের ক্ষেত্রেই। এভাবে দেখা যায়, হাকিম শব্দের অর্থ সকল সময় ফৌজদারি আদালতের বিচারককেই বুঝায় না, বরং যৌক্তিকভাবেই বলা চলে যে, জজ-এর প্রতিশব্দ হিসেবে কেবলমাত্র হাকিম শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে, ম্যাজিস্ট্রেট-এর প্রতিশব্দ হিসেবে নয় কিছুতেই।

লক্ষণীয় যে, কোনো অভিধানেই কিন্তু হাকিম শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানেও ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের বাংলা করা হয়েছে ‘ফৌজদারি আদালতের বিচারক’ হিসেবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘আইন শব্দকোষ’ (২০০৬) অভিধানেও Magistrate শব্দের প্রতিশব্দ ম্যাজিস্ট্রেট-ই করা হয়েছে, হাকিম নয় (পৃ. ৬৪৭), বরং এই শব্দকোষে Judge শব্দের বাংলা হিসেবে হাকিম শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে (পৃ. ৫৬৯)।

এভাবে দেখা যায়, যেখানে (ক) ইংরেজি এই Magistrate শব্দটি বহু আগে থেকেই বাংলায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আত্তীকৃত হয়েছে; (খ) এর কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই কিংবা হাকিম ম্যাজিস্ট্রেট-এর বাংলা প্রতিশব্দ নয়; (গ) ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি দিয়ে কেবলমাত্র ফৌজদারি মামলার বিচারককে বুঝানো হয়ে থাকে; (ঘ) আমাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে এবং (ঙ) আম জনতা হাকিম-এর চেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথেই অধিক পরিচিত; সেখানে নিশ্চিত করেই বলা যায়, হাকিম নয় মোটেও বরং ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির ব্যবহারই সঠিক, শুদ্ধ ও যুক্তিযুক্ত। অথচ অদ্ভূতভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলোসহ একাধিক পত্রিকা ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের বাংলা তর্জমায় সব সময় হাকিম শব্দটিই ব্যবহার করে আসছেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, তাঁরা কি এটা বুঝে করছেন নাকি না বুঝে করছেন, নাকি তারাই সঠিকটা করছেন? না বুঝে করতেই পারেন, যেমন আমরা প্রত্যেকই এমন ভুল অহরহই করে থাকি, কিন্তু বুঝে করলে জানতে চাই- তাঁদের যুক্তিটা কী? আমি বলি কি, ভাষার শুদ্ধতা তো একটা বিষয় বটেই, কিন্তু ভাষার প্রকাশ ও বুঝার মধ্যে তৃপ্তি বলতে একটা বড়ো বিষয়ও কিন্তু আছে। যেমন, ক্যানসারকে কর্কটরোগ, সেলফিকে নিজস্বী এবং ফেসবুককে মুখবই বললে যেমন এদের যথাযথ ভাব প্রকাশ হয় না, তেমনি ম্যাজিস্ট্রেটকে হাকিম বললে ভাবটাও যেমন নিগূঢ় হয় না, বোধেও তেমন তৃপ্তি আসে না পরিপূর্ণভাবে।

এই সকল দিক বিবেচনায় রেখেই এই বিতর্কের অবতারণা এবং আমার অনুসন্ধিৎসা। লিখাটা হাকিম-ব্যবহারজীবীদের নজরে পড়লে তাঁদের যুক্তিটা জানার অপেক্ষায় রইলাম অধীর আগ্রহে।

লেখক: অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা।