সংসদীয় কমিটির বৈঠক

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব সংসদীয় কমিটির

সংসদে উত্থাপিত বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার শিরোনামসহ ১১টি সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রস্তাবনায় বিতর্কিত ৩২ ধারা ছাড়াও বিলের ৮, ১৮, ২১, ২৫, ২৮, ৪৩, ৪৬ ও ৬১ দফা বা ধারা সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।

গণমাধ্যমের আপত্তির মুখে এই আইনের বিতর্কিত ৩২ ধারার ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দ বাদ দিয়ে ধারাটি চূড়ান্ত করার কথা ভাবছে সংসদীয় কমিটি। তবে গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আরেক দফা বসার পরেই এ বিষয়ে সব চূড়ান্ত করার কথা ভাবছে কমিটি। এজন্য আগামী ১৬ জুলাই ফের বৈঠকে বসবেন সংসদীয় কমিটি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।

গতকাল বুধবার (০৪ জুলাই) বিকেলে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৪তম বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে।

কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, বিশেষ আমন্ত্রণে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক অংশ নেন।

এছাড়া কমিটির আমন্ত্রণে অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু, বিএফইউজে এর সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বৈঠকে যোগ দেন।

বৈঠকে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে চলমান বিতর্ক ও গণমাধ্যমকর্মীদের মতামত আমলে নিয়ে বিলের পূর্ণাঙ্গ শিরোনাম, প্রস্তাবনাসহ বেশ কিছু ধারা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনাও তৈরি করা হয়েছে।

কমিটির প্রস্তাবিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-১৯২৩ এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডের বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে।’

সংসদে উত্থাপিত বিলের এই ধারায় একই পরিমাণ শাস্তির কথা উল্লেখ থাকলেও বলা রয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’

এছাড়া, প্রস্তাবিত আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হয়েছে। এর সংজ্ঞা হবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে, তা এখানে প্রযোজ্য হবে। ২৫ নম্বর ধারার ‘খ’ উপধারা (এমন কোনও তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করা, যা কোনও ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে) বাতিল ও সব মিলে দুটি উপধারা করা, ২১ ধারায় সাজা যাবজ্জীবনের ক্ষেত্রে ১৪ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ সাজার কথা আইনে বলা হয়েছে। অপরাধ বিবেচনায় আদালত ঠিক করবে সর্বনিম্ন সাজা কতদিন হবে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সাজা ও জরিমানার পরিমাণ কমানো এবং কিছু শব্দগত পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাতের শাস্তির মাত্রাও সাত বছর থেকে কমিয়ে ৫ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেওয়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘যে যে পরিবর্তনগুলো করা প্রয়োজন ছিল, সে পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে। তারা (সাংবাদিক পক্ষ) বলেছেন, এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে তারা তাদের নিজস্ব ফোরামে আলোচনা করবেন। ১৬ জুলই আবার বৈঠক হবে।’

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞায় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯৮৩ অনুসরণ করার কথা বলা হয়। এই আইনটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। এ বিষয়টি আরও পর্যালোচনা করা হবে।

কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ জানান, গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আরেক দফা বসার পরেই সব চূড়ান্ত করার কথা ভাবছে কমিটি। এজন্য আগামী ১৬ জুলাই পুনরায় বৈঠকে মিলিত হবে সংসদীয় কমিটি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।

তিনি বলেন, আমরা একটি ভালো আইন চাই। যেন সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তাই সকল স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করছি। এই নজির খুব কমই আছে।আগে যেসব বিষয়ে আপত্তি এসেছিলো আশা করি পরবর্তী বৈঠকে সমাধান হবে।

আগামী ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে বিলটি চূড়ান্ত করে আগামী অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসেই উত্থাপন করা সম্ভব হবে বলে আশা করেন ইমরান আহমেদ।

বৈঠক শেষে মাহফুজ আনাম বলেন, সংসদীয় কমিটি কিছু সংশোধনী দিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে আলাচনা হচ্ছে। তবে আজকের বৈঠকে কমিটির সভাপতি মন্ত্রীদের সহযোগিতার মনোভাব দেখা গেছে।

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আমরা অনেকগুলো ধারা নিয়ে আপত্তি দিয়েছিলাম, আজ তারা তাদের ব্যাখা দিয়েছেন। আমরা টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন (অ্যাটকো) ও বিএফইউজের নেতাদের সঙ্গে বসবো। সেখানে আজকের ব্যাখা তুলে ধরবো এরপর আগামী বৈঠকে আমরা আমাদের কথা তুলে ধরবো।

মোজাম্মেল হক বাবু বলেন, ডিজিটাল ফেয়ারের নামে যে নৈরাজ্য চলছে তার প্রতিকারে জন্য আইনের প্রয়োজন। সেই আইন করার ব্যাপারে আমরা ও সরকার একমত। ডিজিটাল ফেয়ারের নামে সৎ সাংবাদিকতারও একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমরা আমাদের অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসে পরবর্তী বৈঠকে বক্তব্য তুলে ধরবো।

এর আগে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম তথ্য-প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন করা হয় । পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে শাস্তি বাড়িয়ে এটিকে আরো কঠোর করা হয়। এই আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ হয়রানির শিকার হন।