অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

বহুবিবাহ ও আইনগত প্রতিকার

সিরাজ প্রামাণিক: সিথির জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। একুশ বছরের সংসার জীবন তছনছ করে স্বামী আরেকটি বিয়ে করেন। বিয়ের আগে প্রায় দুই বছর ধরে মহিলার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলেন। স্বামীকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সিথির চেষ্টার কমতি ছিল না, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সিথির দুটি মেয়ে। ওর বাবা নতুন বউকে নিয়ে নতুন সংসারে সুখেই আছে। টাকার অভাবে মেয়ে দুটি কণা ও কথা’র পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। সিথি তার কন্যা দুটি নিয়ে বর্তমান বাবার টানাপোড়েন সংসারে কোন রকম দিনাতিপাত করছেন। এইতো সিথি সেদিন আমার চেম্বারে এসেছিল আইনগত পরামর্শ নিতে।

এক স্ত্রীর বর্তমানে আরেকটি বা একাধিক বিবাহ করাকে বহু বিবাহ বলে। ইসলামী আইনে বলা হয়েছে, কেউ যখন বস্তুগত দিক দিয়ে এবং স্নেহ ভালবাসার দিক দিয়ে প্রত্যেক স্ত্রীর সাথে সমান আচরণ করতে পারবে কেবল মাত্র তখনই সে চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পারবে। তবে বাস্তবে এটা কখনও সম্ভব নয়। কারণ যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে ভালবাসে তার দ্বিতীয় বিবাহ করার ইচ্ছেই হবে না। কাজেই পবিত্র কোরআন শরীফে বহু বিবাহকে অনুমতি দেবার চেয়ে একটি বিবাহ করাই উত্তম বলে উল্লেখ করেছে। আমাদের সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আইনগত অধিকার স্বামীদের থাকলেও নারীদের ক্ষেত্রে এ ধরণের বিধান নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, একই সঙ্গে স্বামী চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না।

বহুবিবাহের আর্থসামাজিক বাস্তবতা
ইসলামে বহুবিবাহের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ইসলাম আবির্ভাবের প্রথমদিকে একটি ভিন্ন আর্থসামাজিক ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায়। মূলত বিধবা, এতিমদের নিরাপত্তা ও রক্ষার জন্য ইসলামে এ ধরণের প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেসময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওহুদের যুদ্ধে বহু মুসলিম পুরুষ শাহাদত বরণ করেন, ফলে স্বাভাবিকভাবে অভিভাবক ও স্বামীহীন নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এসব নারীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য বহুবিবাহ প্রথা চালু হয়।

কোরআন শরীফের বিধান
পবিত্র কোরআন শরিফের সূরা নিসায় পরিষ্কার উলেœখ রয়েছে ‘যদি তুমি আশঙ্কা কর যে, এতিমদের প্রতি তুমি সুবিচার করতে পারবে তবে তুমি এ ধরনের নারীদের বিয়ে করতে পারো যাকে ভাল লাগে তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন অথবা চার। কিন্তু যদি তুমি আশঙ্কা কর যে, এদের মধ্যে তুমি সুবিচার করতে পারবে না তবে তাদের মধ্যে থেকে অথবা যারা তোমার আশ্রয়ে রয়েছে তাদের মধ্য থেকে একজনকেই বিয়ে কর। অন্যায় এড়ানোর এটাই সহজ ও উত্তম ব্যবস্থা।’ এখানে সুবিচারের প্রশ্নে শুধু স্বামীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতার সমান ব্যবহারের কথা বলা হয়নি বরং স্নেহ মায়া, ভালবাসা, আদর সোহাগের বিষয়ে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামীরা কি আদৌ আদর সোহাগের মতো সূক্ষ্ম অনুভূতির ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার করতে পারে? মূলত এটা অসম্ভব তাই বলা যায়, শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন সাপেক্ষে বহু বিবাহকে কঠিন নিষেধাজ্ঞাতে পরিণত করেছে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ধারা ৬ মতে, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিশি পরিষদের নিকট হতে অনুমতি না নিলে বিয়ে নিবন্ধন হবে না। অনুমতির জন্য ২৫ টাকা ফি দিয়ে সাদা কাগজে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি প্রদানে যে সকল বিষয়ের প্রতি বিবেচনা করা হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো যথা-১) বর্তমান স্ত্রীর বন্ধাত্য, ২) দৈহিক দৌর্বল্য, ৩) দাম্পত্য জীবন সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা এবং ৪) দাম্পত্য অধিকার পূনর্বহালের জন্য কোন উম্মত্ততা।

স্ত্রীর অধিকার লঙ্ঘনে আইনী প্রতিকার
কোন পুরুষ যদি সালিশি পরিষদের অনুমতি বিনা দ্বিতীয় বিবাহ করেন তবে তিনি ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬(৫) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। তিনি অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের আশু বা বিলম্বিত দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করবেন এবং মোহরানার টাকা পরিশোধ করা না হলে বকেয়া ভূমি রাজস্ব আদায়ের মতো আদায় করা হবে। এছাড়াও অভিযোগে দোষী সাব্যস্থ হলে ১ বৎসর পর্যন্ত জেল ও ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড কিংবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। পাশাপাশি দন্ডবিধি আইন ১৮৬০ এর ৪৯৪ এর বিধান মতে, স্বামী যা স্ত্রীর জীবনকালে পুনরায় বিবাহ করেন তবে সে ব্যক্তি যে কোন বর্ণনার কারাদন্ডে যার মেয়াদ সাত বৎসর পর্যন্ত হতে পারে তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা উচিত, বহু বিয়ের মামলায় বাদীকে সফল হতে হলে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, দ্বিতীয় বিয়ের সময় প্রথম বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব ছিল।

বহু বিবাহের আইনগত দিক
পরিতাপের বিষয় এই যে, বেশিরভাগ মানুষ কেউ বুঝে, অথবা কেউ না বুঝেই সূরা নিসার অপব্যাখ্যা প্রদান করে। ফলে সমাজে কোন কোন পুরুষ যথেচ্ছাভাবে একাধিক বিয়ের মধ্য দিয়ে পারিবারিক জীবনে মহা জটিলতার সৃষ্টি করে, যার ফলে উদ্বেগজনক প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের সংখ্যা। এ জাতিয় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৯৬১ সালে আইন প্রবর্তন করা হয় যা মুসলিম পাবিরারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ নামে পরিচিত। এ আইন অনুযায়ী পূর্বাহ্নে সালিশী পরিষদের নিকট হতে লিখিত অনুমতি না নিয়ে কোন পুরুষ একটি বিবাহ বলবৎ থাকাকালে আর একটি বিবাহ করতে পারবে না এবং পূর্বানুমতি গ্রহণ না করে এই জাতীয় কোন বিবাহ হলে তা মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯৭৪ মালের ৫২ নং আইন মোতাবেক রেজিষ্ট্রী হবে না)।

  • বিয়ের অনুমতির জন্য নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এং আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত বিবাহের কারণ এবং বর্তমানে স্ত্রী বা স্ত্রীগণের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কিনা তা উল্লেখ করতে হবে।
  • আবেদনপত্র পাঠাবার পর চেয়ারম্যান আবেদনকারী ও তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণকে তাদের নিজ নিজ প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে বলবে এবং সালিশী পরিষদ যদি মনে করে যে, প্রস্তাবিত বিবাহটি প্রয়োজন ও ন্যায়সঙ্গত তা হলে কোন শর্ত থাকলে সে সাপেক্ষে প্রার্থীর বিবাহের অনুমতি মঞ্জুর করতে পারে।
  • আবেদনপত্র সম্পর্কে সিদ্ধান্তকালে, সালিশী পরিষদ এ সিদ্ধান্তের কারণ সমূহ লিপিবদ্ধ করবে এবং কোন পক্ষ নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট সহকারী জজের পুনর্বিচারের জন্য আবেদন করতে পারবে এবং এতে সহকারী জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে এবং এর বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
  • বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের প্রাপ্য মুয়াজ্জল বা মু-অজ্জল দেনমোহরের টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করবে। সে টাকা ওইরূপে পরিশোধ করা না হয় তা হলে বকেয়া ভূমি রাজস্ব রূপে আদায় করা হবে।

বহু বিবাহেরে ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যান সাহেবের দায়-দায়িত্ব

  • বহু বিবাহের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সাহেব স্বামীকে অনুমতি দিতেও পারে আাবার নাও দিতে পারে।
  • যদি কোন স্বামী সালিশী পরিষদের মাধ্যমে অনুমতি পেয়ে যায় তাহলে চেয়ারম্যান সাহেব তাকে স্মারক নং- সহ দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি প্রদান করবে।
  • অনুমতি ব্যতিত স্বামী বহু বিবাহ করলে চেয়ারম্যান সাহেব তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বর্তমান স্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে
  • সালিশী পরিষদের অনুমতি ব্যতিত কোন ব্যক্তি যদি অন্য একটি বিবাহ করে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব
  • ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।

বহু বিবাহের ক্ষেত্রে কাজী সাহেবের দায়-দায়িত্ব

  • বিবাহটি বরের বহু বিবাহ কিনা তা যাচাই করবে।
  • সলিশী পরিষদের লিখিত অনুমতি আছে কিনা তা দেখবে।
  • সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কাজী সাহেব যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারে আবার সন্দেহ হলে বিবাহটি নাও রেজিষ্টি করতে পারে।

সিথির সাথে কথা বলে বোঝা গেল তাঁর হৃদয়ের ভেতরের অশান্তি ও অস্থিরতা। এমনটি যদি আপনার কোন বোন কিংবা মেয়ের জীবনে হতো তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হতো। জবাব খুঁজি!

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email: seraj.pramanik@gmail.com