অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে

বাদল ফরাজী নির্দোষ নয় বা তার মুক্তিও সম্ভব নয়

কুমার দেবুল দে:

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এক নাম বাদল ফরাজী। বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা বাদল ফরাজীর বাবার নাম খালেক ফরাজী। তার মায়ের নাম সারাফালি বেগম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বাদল হলো দ্বিতীয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ২০০৮ সালে টুরিস্ট ভিসায় বেনাপোল বর্ডার পার হওয়ার পরপরই দিল্লির অমর কলোনির এক বৃদ্ধা হত্যা মামলায় বাদল ফরাজীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২০০৮ সালের ৬ মে সেই বৃদ্ধাকে হত্যার ঘটনায় দিল্লির পুলিশ বাদল সিং নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজছিল। ওই বছরের ১৩ জুলাই বেনাপোল বর্ডার দিয়ে বাদল ফরাজী ভারতে প্রবেশ করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর উক্ত মামলায় বাদল ফরাজীকে ভারতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওবাদল ফরাজীর পরিবার থেকে দাবী করা হয়েছে তিনি নির্দোষ।

শোনা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের ৬ মে সেই বৃদ্ধাকে হত্যার ঘটনায় দিল্লির পুলিশ বাদল সিং নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজছিল। ওই বছরের ১৩ জুলাই বেনাপোল বর্ডার দিয়ে বাদল ফরাজী ভারতে প্রবেশ করলে বাদল সিং মনে করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষা না জানার কারণে দীর্ঘদিন ধরে তাকে কারাবন্দি হয়ে থাকতে হয় এবং এই অবস্থাতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ভারতের একটি আদালত যাবজ্জীবন সাজা পরবর্তীতে ভারতীয় একটি এনজিও বাদল ফরাজীর ঘটনা জানতে পেরে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে। ঢাকার পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেষ্টায় ২০০৪ সালের বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফেরত আনা হলো।

গত শুক্রবার ৬ জুলাই বিকালে বাদল ফরাজীকে দেশে ফিরিয়ে আনার সময় তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকলেও তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারেননি। বাদল ফরাজীকে ফিরিয়ে আনা দুই পুলিশ কর্মকর্তা বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাকে বিমানবন্দর থানায় নিয়ে যান। সেখান থেকে সোজা তাকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারএখন সাধারন্যের প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতেই পারে “ বাদল ফরাজী যদি নির্দোষ হয় তবে বাংলাদেশে ফেরত আসার পরেও কেন একজন নির্দোষ ব্যাক্তি জেল খাটবেন?”। এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।

বাদল ফরাজীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে মুলত নির্দোষ ব্যক্তি হিসাবে নয়, তাকে একজন দন্ডপ্রাপ্ত দোষী ব্যক্তি হিসাবে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয় ২০১৩ সালে ২৮শে জানুয়ারী বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পাদিত “TREATY BETWEEN THE THE REPUBLIC OF INDIA AND PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH RELATING TO EXTRADITION”। এবং তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ ভারত বন্দি বিনিময় চুক্তি এর আর্টিকেল ৯ এর অধীনে, এই আর্টিকেলটি আমি নিচে হুবহু তুলে ধরলাম, “ To the extent permitted by its law, where a person serving a sentence in the Requested State has been found extraditable, the Requested State may temporarily surrender the person sought for the purpose of prosecution to the Requesting State in accordance with conditions to be determined between the Contracting States. A person who is returned to the Requested State following a temporary surrender may be finally surrendered to the Requesting State to serve any sentence imposed, in accordance with the provisions of this Treaty and existing law of the requested country”।

এই আর্টিকেলের ভাষ্য মতে বাদল ফরাজী তার যাবজ্জীবন সাজার মধ্যে ইতমধ্যে ১০ বছর খেটেছেন এবং এই সাজার বাকী অংশ তিনি বাংলাদেশের জেলে খাটবেন। যদিও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যাবজ্জীবন সাজা আসলে কত বছর খাটতে হয় সেইটা নিয়ে একটা জটিলতা আছে। কারণ আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র মামলায় ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ সালে প্রদত্ত রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট আপীল বিভাগের রায়ে যাবজ্জীন সাজাকে আমৃত্যু কারাবাস বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যদিও এর আগে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আপীল বিভাগের একটি বেঞ্চ যাবজ্জীবন সাজা মানে সাড়ে ২২ বছরের জেলও বলেছেন। অপরদিকে ইন্ডিয়াতে একজন যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত আসামী ১৪ বছর জেল খেটে ফেললে তার নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত হওয়ার একটা অধিকার জন্মায়, সেই হিসাবে আর মাত্র ৪ বছর জেল খাটলেই বাদল ফরাজী হয়তো দেশে ফিরে আসতে পারতেন। এই অবস্থায় এই সময়ে দেশে ফেরত আসা বাদল ফরাজীকে উল্টো আরেক অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছে।

এমতাবস্থায় আরেকটা পথ তার হাতে খোলা আছে, আর তা হল তার যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে আপীল করে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় উচ্চ আদালতে আপীল করা। যেহেতু সে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের জেলে আছে সেই হিসাবে ধরে নেয়া হবে সে ভারতের জেলেই অন্তরীন আছে এবং বাংলাদেশের জেলে থাকা তার ভারতের উচ্চাদালতে আপীল অধিকারকে ক্ষুন্ন করবেনা। অথবা বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করে নির্দোষ প্রমানিত হওয়ার সুযোগ নেয়া। এইক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের নির্বাহী কোন আদেশ দিয়ে বাদল ফরাজীকে মুক্ত করার কোন সুযোগ বাংলাদেশ ভারত বন্দী বিনিময় চুক্তি, ২০১৩ দেয় নাই। এখন যা হবে তা উভয় দেশের উচ্চ আদালতের যেকোন একটিকে পছন্দ করে আপীল দায়েরের মাধ্যমেই হবে এবং আইনী প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেই শুধু ভাল কিছু হওয়া সম্ভব নতুবা নয়। তাই ভরসা শুধুই উচ্চ আদালত।

লেখক: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সাবেক সদস্য।