তালাক দেয়ার নিয়ম-কানুন নিয়ে যত সব বিভ্রান্তি!

সিরাজ প্রামাণিক:

প্রথমেই তালাক সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনাটি শুধরে নিই। মুখে মুখে তিন বার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে বা একসাথে ‘বায়েন তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে তালাক কার্যকরী হয় না। এমনকি, মুখে উচ্চারণ ব্যতিত লিখিতভাবে তালাক দিলেও তা সাথে সাথে কার্যকরী হয় না।

মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিস্কের স্বামী যে কোন সময় কোনরূপ কারণ ব্যতিরেকেই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর ক্ষমতা একচ্ছত্র, কিন্তু এজন্য আইনের বিধান মেনেই তা করতে হয়। বিধান না মানা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেবার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে, স্বামী তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর স্ত্রী সে সময় যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সাথে তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তখনই/ পরবর্তী সময়ে/ যথাশীঘ্রই সম্ভব।

যা পাঠাচ্ছেন এটিই তালাকের নোটিশ, এর জন্য আইন নির্দিষ্ট কোনো ফরম বা বক্তব্য নির্ধারণ করেনি। নোটিশ লেখা বা পাঠানোর কাজটি তালাকদাতা নিজেও করতে পারেন, আবার অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারেন। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিষ্ট্রি করে এডি সহযোগে পাঠালে ভাল হয়। সরাসরি পাঠালে নোটিশের এক কপি করে রিসিভ করে নেয়া ভাল।

চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। উল্লেখ্য, নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে। তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)। সালিশি পরিষদ ৯০ দিন সময় পেয়ে থাকে।। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে। এর মধ্যে স্বামী নোটিশ প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হবে। কিন্তু নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক কার্যকর হবে না।

নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী অন্য কারও সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে উক্ত বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। (সৈয়দ আলী নেওয়াজ বনাম কর্ণেল মোঃ ইউসুফ, ১৫ ডি.এল.আর. (আপিল বিভাগ) পৃষ্ঠা-৯)। কারণ তালাক সম্পূর্ন কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগন আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।

এখানে মনে রাখা দরকার যে, নোটিশ পাঠানোর কোনো দায়িত্ব বিধিবদ্ধভাবে কাজির নেই। যিনি তালাক দিলেন, তিনিই কাজটি করবেন। তবে কোনো তালাকদাতা যদি নিজের অসামর্থ্য বা অজ্ঞতার দরুন কোনো কাজিকে ওই কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মনে করেন, তবে তিনি কাজীকে দিয়ে নোটিশ পাঠানোর কাজটি করাতে পারেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশের বেশির ভাগ কাজিই ‘মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭(১) ধারায় তালাকের নোটিশ’ ধরনের শিরোনামযুক্ত নোটিশ নিজেরাই ছাপিয়ে রেখেছেন এবং সেগুলো দিয়ে যার যার চাহিদামতো তালাকের নোটিশ পাঠাচ্ছেন।

নির্ধারিত নিয়ম ও সময়ান্তে প্রদত্ত একটি তালাক যদি কার্যকর হয়, তখনই কেবল তা রেজিস্ট্রি করার সুযোগ আসবে। বিদ্যমান আইনের বিধানমতে, মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রি করানো বরের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও তালাকের ক্ষেত্রে তা তালাকদাতার ইচ্ছাধীন। তবে কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করার আগে ওই তালাকটি বিধি অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা কাজির রয়েছে। কাজিরা তালাকদাতার হয়ে নোটিশ তৈরি ও পাঠানোর যে কাজটি করে থাকেন, তা শুধু তালাকের ঘোষণা হিসেবে কাজ করবে। ওই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত কার্যকর না-ও হতে পারে। তাই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তালাক রেজিস্ট্রি করে ফেলার সুযোগ কাজির নেই। তিনি যদি সেটা করে থাকেন, তাহলে ওই রেজিস্ট্রেশন কার্যকর হওয়া কোনো তালাকের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না। কেবল মাত্র ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পরে একজন নিকাহ রেজিস্টার কর্তৃক তালাক এর সার্টিফিকেট গ্রহণ করা যায়।

আবার বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী যেহেতু তালাক প্রদানের সময় স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন, সেই এলাকায় তা কার্যকর হয় এবং সেই এলাকার কাজির কাছেই তা রেজিস্ট্রিও করতে হয়; সেহেতু তালাক কার্যকরকারী পক্ষদ্বয়ের মধ্যে স্ত্রীর বসবাস যে এলাকায়, সেই এলাকার বাইরের কোনো কাজির সুযোগ নেই তাঁদের মধ্যকার তালাকটি রেজিস্ট্রি করার। আর পেছনের তারিখ ব্যবহার করে কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করা অসদাচরণ তো বটেই, রীতিমতো অপরাধও।

উল্লেখ্য যে, স্বামী যদি চেয়ারম্যান এবং স্ত্রীকে নোটিশ প্রদান না করে তাহলে স্বামী এক বছর বিনাশ্রম কারাদ- অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দ-নীয় হবেন, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। উক্ত তালাক কার্যকর হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে অধ্যাদেশের কোথাও নোটিশ প্রধান না করলে তালাক হবে না এই বিধান উল্লেখ নাই। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সিভিল রিভিশন নং ৬৯৮, ১৯৯২, মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছাঃ হেলেনা বেগম ও অন্যান্য।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮