‘নৌকা’র টিকিটপ্রত্যাশী পেশাজীবীদের মধ্যে এগিয়ে আইনজীবীরা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তৎপর দেশের অর্ধশতাধিক পেশাজীবী নেতা। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলের শীর্ষ পর্যায়ে দেনদরবারের পাশাপাশি তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় রাজনীতির মাঠেও সক্রিয় আছেন। ‘নৌকা’র টিকিটপ্রত্যাশী পেশাজীবীদের মধ্যে বেশিসংখ্যকই হলেন শিক্ষক, চিকিৎসক ও আইনজীবী। এ ছাড়া আছেন কয়েকজন সাংবাদিক, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ।

ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী এই পেশাজীবীদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমান সংসদ সদস্যও আছেন। কেউ কেউ আবার আগে থেকেই দলের উঁচু পদেও আসীন। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও আছেন দু-একজন। তবে বেশির ভাগই নতুন মুখ।

মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন লৌহজং এলাকার কৃতী সন্তান, দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি সমকালকে বলেন, এলাকার মানুষের জন্য কাজ করছি। গত তিন বছর ধরে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বিতরণ, ঈদ ও পূজা-পার্বণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন কাপড় বিতরণ, মন্দিরে অর্থ দেওয়া, অসহায় ও গরিব মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা ধরনের সহযোগিতাও করছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী। এ আসনে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের বেগম সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। প্রধানমন্ত্রী ও দল চাইলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন।

পিরোজপুর-১ আসন থেকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শ. ম. রেজাউল করিম। সুপ্রিম কোর্ট বারের এই সাবেক সম্পাদক পরপর দু’বার বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করছেন। তিনি জানান, নিয়মিত যোগাযোগ রাখায় এলাকার মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেলে জয়লাভের বিষয়ে আশাবাদী তিনি। এ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম এ আবদুল আউয়াল।

অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু ঢাকা-৭ (লালবাগ-কোতোয়ালি) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য তিনি। পুরান ঢাকার রাজার দেউড়ীতে জন্ম নেওয়া এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই নেতা নির্বাচন করার ইচ্ছা জানিয়ে সমকালকে জানান, সভানেত্রী ও দল মনোনয়ন দিলেই কেবল প্রার্থী হবো।

নীলফামারী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্যও তিনি। ওই আসনে বর্তমানে এমপি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা। তুরিন আফরোজ বলেন, নেত্রী ও দল চাইলে আগামী নির্বাচনে যাবো। অনেক আগে থেকেই এলাকার জনগণের জন্য কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন না পেলেও দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে কাজ করব।’

আগামী জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাটুলিয়া) আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ব্যারিস্টার নওফেল বর্তমানে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। এ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলু। এ ছাড়াও এ আসনে রয়েছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।

আগামী নির্বাচনে পাবনা-২ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী রবিউল আলম বুদু। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতা তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাও ছিলেন তিনি। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এই আসনের বর্তমান এমপি। গত বছর ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় আওয়ামী লীগ নেতা বুদুর গাড়িবহরে গুলি, ভাংচুর ও সাংবাদিকদের মারধরের অভিযোগে মন্ত্রিপুত্র শিহরণ শরীফ তমালকে যুবলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। অ্যাডভোকেট বুদু বর্তমানে এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী রাষ্ট্রপক্ষে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনাকারী কমিটির সদস্য এই আইনজীবী নেতা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান। আওয়ামী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য তরুণ ব্যারিস্টার ইমন উচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বিচারের সময় বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেও ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের স্বার্থে সরে দাঁড়ান। সাবেক এমপি আবদুর রইসের যোগ্য পুত্র ইমন সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের দু’বার প্রশাসকও ছিলেন। আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যারিস্টার ইমন এলাকার মানুষের জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

অ্যাডভোকেট এ বি এম রিয়াজুল কবির কাওসার নরসিংদী-৫ রায়পুরা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য। সার্বক্ষণিক প্রচারণাও চালাচ্ছেন তিনি। এ আসনের বর্তমান এমপি সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ।

ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল কালাম আজাদ। এলাকায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এই তরুণ ব্যারিস্টার সমকালকে জানান, গত ১৩ বছর ধরে নিয়মিত এলাকার সব মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহেই এলাকায় যান তিনি এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত আছেন। এই আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ আহমেদ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) দায়িত্ব পালন করছেন মোখলেসুর রহমান বাদল। আগামী নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদি) থেকে নৌকার প্রার্থী হতে চান তিনি। এ জন্য তিনি এলাকায় সার্বক্ষণিকভাবে গণসংযোগ করছেন। এ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোহরাব উদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান জনপ্রিয় অ্যাডভোকেট বাদল ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

ব্যারিস্টার এম আশরাফুল ইসলাম আশরাফ টাঙ্গাইল-৬ (দেলদুয়ার ও নাগরপুর) আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তরুণ এই ব্যারিস্টার যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের আশীর্বাদপুষ্ট আশরাফ দেলদুয়ার ও নাগরপুরে ‘তারুণ্যের মডেল’ হিসেবে পরিচিত। তিনিও এলাকায় গণসংযোগ করে চলেছেন। এ আসনের বর্তমান এমপি খন্দকার আবদুল বাতেন।

ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সুমন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। এ আসনের বর্তমান এমপি সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক মাহবুব আলী।

ব্যারিস্টার মোকসেদুল ইসলাম নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি সমকালকে জানান, নেত্রীর বিবেচনায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি। এ জন্য তিনি এলাকায় কাজ করছেন। এ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির শওকত চৌধুরী।

ব্যারিস্টার শেখ ওবায়দুর রহমান বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মোংলা) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। ছাত্রলীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিনি। নির্বাচনের লক্ষ্যে এলাকায় গণসংযোগ ও সামাজিক কার্যক্রম করে চলেছেন। আসন্ন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ায় এ আসনের এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন তালুকদার আবদুল খালেক।

অ্যাডভোকেট এস এম ফজলুল হক কৃষক লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসন থেকে। এ আসনের বর্তমান এমপি সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফজলুল হক সমকালকে জানান, বিগত তিনটি নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি। তার পরেও এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

আশাবাদী আরও দশ এমপি : আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতি করে এমপি হয়েছেন এমন আইনজীবীও কম নয়। তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন বা করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া (গাইবান্ধা-৫), আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪), খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম (ঢাকা-২), সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮), আবদুল মতিন খসরু (কুমিল্লা-৫), নুরুল ইসলাম সুজন (পঞ্চগড়-২), মাহবুব আলী (হবিগঞ্জ-৪), ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস (ঢাকা-১০), মো. শামসুল হক টুকু (পাবনা-১) ও রহমত আলী (গাজীপুর-৩)। তারাও আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।