দুদক

এসপি মীজানের সম্পদের খোঁজে ৩৪ সংস্থায় দুদকের চিঠি

পুলিশ সুপার (এসপি) মীজানুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীর অঢেল সম্পদের রহস্য উদঘাটন করে মামলা করার পর আরও সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা তদন্তের অংশ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি ৩৪ প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি দুদকের সহকারী পরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলাদা আলাদা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের (আরআরএফ) কমান্ড্যান্ট মীজানুর রহমান, তাঁর স্ত্রী নীপা মীজান ও পরিবারের সদস্যদের নাম উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট তথ‌্য-উপাত্তসহ সংশ্লিষ্ট নথি চাওয়া হয়েছে।

দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তির সম্পদের তথ্য জানা ও যাচাই করতে এ ধরনের চিঠি দেওয়া হয়। ব্যাংকে জমা অর্থের তথ্য, দায়-দেনা এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, রেজিস্ট্রি করা জমিসহ নানা তথ্য পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে।

যেসব দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ভূমি অফিস, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, পিপলস লিজিং কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং সোসাইটি অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), বাংলাদেশ ব‌্যাংক, বেসিক ব‌্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব‌্যাংক, সোনালী ব‌্যাংক, ইসলামী ব‌্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব‌্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ও এসএমই ফাউন্ডেশন। এসব চিঠি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের বরাবর পাঠিয়ে দ্রুত এসব তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও মডেল থানায় মীজানুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী নীপা মীজানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, মীজানুর রহমান ১৯৮৯ সালে সার্জেন্ট (এসআই) হিসেবে তৃতীয় শ্রেণির পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। পরে ১৭ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পুলিশে যোগ দিয়ে পুলিশ সুপার পদমর্যাদায় কর্মরত আছেন।

এই সময়ে তিনি নিজ নামে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৮ শতাংশ জমিতে ২ তলা বাড়ি ও এক হাজার ২৯৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ কৃষিজমি, ঢাকার তেজকুনিপাড়ায় ১ হাজার ৭১৮ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১ হাজার ৮০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের অর্ধেক অংশ, জুরাইনে একটি দোকান, ঢাকায় ১৫ শতাংশ জমি, রাজউকের উত্তরা তৃতীয় ফেজে ৩ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন।

এ ছাড়া দুটি মাইক্রোবাস, আসবাব, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর), ইলেকট্রনিকস, মেয়ের নামে শেয়ার, হাতে ও নগদে প্রায় দুই কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হস্তান্তর/রূপান্তর করে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন। একজন সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়া ছাড়াই স্ত্রী, মেয়ে ও পিতার নামে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে রেজিস্ট্রিভুক্ত কেরানীগঞ্জে একটি সার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ওই প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব আসামি মীজানুর রহমান পরিচালনা ও প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া নামে-বেনামে মেঘনা ফার্টিলাইজার, মেসার্স খোয়াজ ফার্টিলাইজার কোম্পানি ও ফার্ম নেস্ট অ্যান্ড মিল্ক প্রডাক্টস নামে আরও তিনটি কারখানার মালিক।

মীজানুর রহমানের স্ত্রী নীপা মীজানের নামেও রয়েছে অঢেল সম্পদ । এজাহারে বলা হয়, ২০০৩ সালে মীজানুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় নীপা মীজানের। একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হয়েও স্বামীর ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে রেজিস্ট্রিভুক্ত কেরানীগঞ্জে একটি সার কারখানার মালিক হন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার মিরপুর মাজার রোডে ৫ কাঠা জমির ওপর ৩ তলা ভবন, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১০ শতাংশ জমিতে ২ তলা বাড়ি, ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে ৬৬ শতাংশ জমি, মিরপুর মাজার রোডে ২ কাঠা জমিতে দোকান,গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ৫৩৮ শতাংশ জমি, তেজকুনিপাড়ায় ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এ ছাড়া ব্যবসায়িক মূলধন, হাতে নগদ অর্থসহ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বিপুল পরিমাণ।

দুদকের অনুসন্ধান
২০১২ সাল থেকে মীজানের বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান হলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও তাঁকে দায়মুক্তি দিয়েছিল সংস্থাটি।

দুদক সূত্র জানায়, ২০১৬ সাল থেকে আবারও অনুসন্ধান শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে। নিজের বাড়ি নির্মাণের সময় পুলিশের ৬০ জন সদস্যকে রাজমিস্ত্রির সহকারী বা জোগালির কাজ করানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল, সাভারের হেমায়েতপুরের আলীপুর ব্রিজ-সংলগ্ন ৮৪ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি তৈরি ও ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের আলমাস টাওয়ারের পাশে আরও একটি বাড়ি নির্মাণে জোগালি ও শ্রমিক হিসেবে সাব-ইন্সপেক্টরসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশের ৫০ থেকে ৬০ জন সদস্যকে দিয়ে কাজ করান মীজানুর রহমান। সরকারি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজে খাটানো এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামেন দুদকের উপপরিচালক এস এম মফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে মীজানের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

পরে অনুসন্ধানের ক্ষেত্র আরও বেড়ে যায়। মীজানের বিরুদ্ধে নকল সার কারখানা পরিচালনার অভিযোগ ওঠে। এটিও যুক্ত হয় অভিযোগ নথিতে। এর মধ্যে নতুন করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মীজান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধ মামলা করলেন।

অদৃশ্য প্রভাবে বারবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে মীজান
২০১২ সালে মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদক যে অনুসন্ধান করেছে, তখন সংস্থার চারজন কর্মকর্তা আলাদাভাবে অনুসন্ধান করেও তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাননি। একাধিকবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করেও মামলা করার মতো কিছু পায়নি দুদক। তাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে মীজানকে অব্যাহতি দিয়েছিল সংস্থাটি। তবে এ বিষয়ে দুদকেও কানাঘুষা ছিল। প্রভাব খাটিয়ে দুদক থেকে দায়মুক্তির সনদ নিয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছিল।

দুদক সূত্র জানায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে অনুসন্ধান শুরু হয়। উপপরিচালক গোলাম মোরশেদ অনুসন্ধান শুরু করলেও পরে আরেক উপপরিচালক ফজলুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুজনই মীজানুর রহমানকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিলেও কমিশন তা গ্রহণ করেনি। পরে আবার অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক হামিদুল হাসানকে। হামিদুল হাসানও অভিযোগটি নথিভুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুপারিশ করেন। এ সুপারিশ অগ্রাহ্য করে উপপরিচালক মো. আবদুস সোবহানকে পুনরায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয় কমিশন।

দুদকে আসা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৪ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮ বছরে তিনি কয়েক শ’ বিঘা স্থাবর সম্পত্তি কিনেছেন। ব্যাংকে তাঁর নগদ অর্থ রয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। তাঁর স্ত্রীর নামে লাইসেন্স নেওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বৈধ করেন। এসব রেকর্ডে মীজানের স্ত্রী নীপা মীজানের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চান অনুসন্ধান কর্মকর্তা হামিদুল হাসান। কিন্তু কমিশনের ওপর মহল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে অদৃশ্য ইশারায় অনুসন্ধান নথিভুক্তির সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

সর্বশেষ অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. আবদুস সোবহানের অনুসন্ধান চলার সময় নোটিশ ছাড়াই বেশ কয়েকবার এসপি মীজানুর রহমানকে দুদকে আসতে দেখা যায়। এ সময় তিনি সাক্ষাৎ করেন দুদকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে। আর এর ফলে পুনঃ অনুসন্ধান প্রতিবেদনেও তাঁর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়েরের পরিবর্তে নথিভুক্তির সুপারিশ আসে।

এর আগে ২০১১ সালে এসপি মীজানের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম। অনুসন্ধানে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় স্ত্রী নীপা মীজানের নামে ব্যবসা পরিচালনা, ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। তিনি মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করলেও মামলা না করে অভিযোগটি নথিভুক্ত হয়ে যায়।