বিচারপতি এস কে সিনহার স্বপ্নভঙ্গ: বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক

‘এস কে সিনহার স্বপ্নভঙ্গ: বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, সরকার বা কোনো এজেন্সি নয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা নিজেই বিচার বিভাগকে কলুষিত করেছেন। বিচার বিভাগের কলঙ্কের জন্য তিনি নিজেই দায়ী। তিনি বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিচারপতি এস কে সিনহার স্বপ্নভঙ্গ: বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) তিনি একথা বলেন।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কামরুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি সিনহা বিচার বিভাগ নিয়ে যে বইটি লিখেছেন, তাতে তার নামকরণ সঠিক হয়েছে। কারণ তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তিনি জুডিশিয়াল ক্যু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। তিনি নিজেই এর জন্য দায়ী। তিনি ইচ্ছে করেই বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে, একটি গোষ্ঠীকে উসকে দেয়ার জন্য তিনি নিজেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্বপ্নভঙ্গের বইটি লিখেছেন।

তিনি বলেন, একটি ঘটনায় একবারই বিচার হবে। কিন্তু একই ঘটনায় বিভিন্নভাবে, একাধিক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মাধ্যমে একাধিক অভিযোগ বা মামলা হতে পারে। কিন্তু সবগুলো অভিযোগ বা মামলা একত্র করে একবারই বিচার হবে। তাই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন আইনমন্ত্রীকে যা বলেছেন তা সঠিক নয়। মইনুল যদি তার এতই প্রিয় হয়ে থাকেন, তাহলে ড. কামাল হোসেন তো তার পক্ষ থেকে নারীদের কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।

কামরুল ইসলাম আরও বলেন, সিনহার মতো বিচারপতি যাতে আর নিয়োগ না হয় সে জন্য উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের আইনটি হওয়া উচিত। তাহলে এ রকম বিচারকের নিয়োগ থেকে আমরা রেহাই পাবো।

অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, আমার দৃষ্টি বিচারপতি এস কে সিনহা একজন ব্যক্তি। তিনি খুব বড় কেউ নন। তিনি দেশের বাইরে চলে গেলেন, কথা বললেন এতে দেশে কী ক্ষতি হলো, বিচার বিভাগের কী ক্ষতি হলো তা দেখতে হবে। বিচার বিভাগে প্রলয় ঘটে গেছে। এই ক্ষত সারতে হবে।

দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় বলেন, মি. সিনহার মধ্যে উচ্চাভিলাষ ছিল। সে কারণেই তিনি বিচারব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তবে একজন দু’জন খারাপ রাজনীতিবিদের কারনে যেমন সকল রাজনীতিবিদরা খারাপ হতে পারেন না ঠিক তেমনি নিশ্চয় বিচারপতি সিনহার কারনে পুরো বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

তিনি আরও বলেন বিচারপতি সিনহা যেদিন সাকার পরিবারের সাথে দেখা করলেন সেদিন থেকেই তিনি বিচারপতি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন। কোনো দলই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয় না। এ নিয়ে সব সরকারের মধ্যেই লুকোচুরি দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও যুদ্ধাপরাধ মামলাসহ সিনহার সব রায়েই কিন্তু সরকার খুশি। কিন্তু ১৬তম সংশোধনীর রায়ে সরকার খুশি হতে পারেনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, সিনহাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় তার সততা, যোগ্যতা বিবেচনায় আসেনি। দেখা হয়েছে তার আনুগত্য। ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল ও তার মধ্যে কী হয়েছে তা সিনহা বইয়ে লিখেছেন। এই বিচার বিভাগই এক সময় বলবে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান নির্দোষ।

ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিচারপতি সিনহা নিয়মিত রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। সে প্রেক্ষাপটে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও বিতর্কিত পর্যবেক্ষন দিয়ে নিজেকে একটি রাজনৈতিক পক্ষে দাঁড় করিয়েছিলেন। পরে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠলে তিনি পদত্যাগ করেন। মূলত তার স্বপ্ন ছিল একটি রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করা। এতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ও ‘স্বপ্নভঙ্গের’ বই রচনা করলেন।

আওয়ামী লীগ নেতা রাশেক রহমান বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের বিচার হবে। একইসঙ্গে উনার (বিচারপতি সিনহা) বই প্রকাশের পর একজন নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ওঠা ব্যক্তির পক্ষে অবস্থান না নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এমন একটা সময় তার স্বপ্ন ভঙ্গের বই প্রকাশ করেছেন যার কিছুদিন পর জাতীয় নির্বাচন। এ সময় একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে চেয়েছেন তিনি। বইটি প্রকাশে তিনি এতোই তাড়াহুড়ো করেছেন যে প্রিন্ট ভার্সনের আগে অনলাইন ভার্সন প্রকাশ করেছেন। যেন তিনি বইটি প্রকাশ করবেন, আলোচনা শুরু হবে আর সাথে সাথেই একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হবে! সব কিছুর মধ্যে একটা যোগসূত্র লক্ষণীয়। বইটি প্রকাশের পর থেকেই বিএনপি নেতারা বইটি নিয়ে আলোচনা সভা-সেমিনার করা শুরু করেছেন। ঘুরেফিরে একটি বই নিয়ে এতো আলোচনা কেন? ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি সম্ভবত পরিকল্পনাই করে রেখেছিলেন যে তিনি পদত্যাগ করবেন, তাড়াহুড়ো করে একটি বই লিখবেন, প্রকাশ করবেন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবেন।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল দেশইনফো.কম.বিডির উদ্যোগে আয়োজিত সাংবাদিক রাশেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই গোলটেবিল বৈঠকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নাজমুল হোসেন কলিমুল্লাহও বক্তব্য রাখেন।

সভাপতির বক্তব্যে রাশেদ চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের এই সংকটে সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। এই অর্জনকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সাফল্যের জন্য, উন্নয়নের ধারবাহিকতা রক্ষার জন্য দলমত নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠক বক্তারা বিচারপতি সিনহার দুর্নীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এই বইটিকে সরকারের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফসল বলে অভিহিত করেন। বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন করার জোর দাবি উঠে আসে এই গোলটেবিল বৈঠকে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন দেশইনফো.কম.বিডির নির্বাহী সম্পাদক সাজেদা হক।