মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা

বছরের পর বছর ঝুলে আছে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা

আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিচারিক আদালত ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন চার বছর আগে। সে দণ্ড এখনো হাইকোর্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়। একইভাবে আছে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) করার মামলাও।

কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে চলতি বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১ হাজার ৬৬৬ আসামি ছিলেন। তাঁদের অনেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে অপেক্ষার পালা ১৫ বছর পর্যন্তও গড়িয়েছে।

বিচারিক আদালতে কোনো মামলায় আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারে। আর আপিলে আসা সিদ্ধান্তের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সংক্ষুব্ধপক্ষের আবেদনও করার সুযোগ আছে।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গেল ১৪ বছরে ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। আর বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স মামলা আছে সাত শর মতো। এখন ২০১৩ সালের ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যা কাম্য নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া সমীচীন। কেননা দেখা যায়, বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত মওকুফ করে দেন বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, বিচারকের সংখ্যা তথা হাইকোর্টে বেঞ্চ অনুপাতে এখন ফাঁসির মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইদানীং নিম্ন আদালতে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসির রায় হচ্ছে, যা ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা বাড়ার একটি কারণ।

সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্র জানায়, বিচারিক আদালত রায় ঘোষণার পর তা অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়, যা একটি নম্বরের মাধ্যমে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। কোনো মামলায় এক বা একাধিক জন দণ্ডিত থাকলে সে ক্ষেত্রে তা একটি নম্বরে নথিভুক্ত হয়। তবে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল ও জেল আপিল করতে পারে। তা সাধারণত ডেথ রেফারেন্সের সঙ্গে শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য ও বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।

ডেথ রেফারেন্স মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, আগে ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে দুটি বেঞ্চ ছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আরও একটি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। ডেথ রেফারেন্স শাখায় কাজের গতি আনতে দক্ষ কর্মচারীদের ওখানে পদায়ন করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিজেও সংশ্লিষ্ট শাখা পরিদর্শন করছেন। ফলে ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির হার এখন তুলনামূলকভাবে বেড়েছে।

জট ছাড়ানোর উপায় কী
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক সূত্রের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে হাইকোর্টে সাত শ ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকলেও ২০০৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৩৮টি। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৭টি ডেথ রেফারেন্স এসেছে। এই সময়ে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৭টি।

ডেথ রেফারেন্স কত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে, আইনে বাঁধাধরা নিয়ম নেই বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম শাহজাহান। ডেথ রেফারেন্স মামলায় আসামিপক্ষে নিয়োজিত অন্যতম এই আইনজীবী নিজ অভিজ্ঞতা থেকে গণমাধ্যমকে বলেন, ডেথ রেফারেন্সের মধ্যে বেশির ভাগই হত্যা মামলা। এরপরই আছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে স্ত্রী হত্যা, গণধর্ষণ ও ধর্ষণ–পরবর্তী হত্যা মামলা। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স বছরের পর বছর ঝুলে থাকার অন্যতম কারণ শুনানি পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরিতে দেরি হওয়া। একই সঙ্গে মামলা অনুপাতে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চের অভাব আছে। কোনো ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে। আবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুতের পর দ্রুত নিষ্পত্তির নজিরও আছে।

১৭ বছর আগে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানসহ (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর) আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ। ২০১৪ সালের ২৩ জুন রায় হলেও আসামিদের ডেথ রেফারেন্স এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় গেল বছরের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পর নিম্ন আদালতে ওই মামলার রায় হয়। এ মামলায় আসা ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলা যে সংখ্যক বিচারাধীন আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ বাড়ানো দরকার এটি সত্যি। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিচারপতি ও ফাঁসির মামলা পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আরও বিচারক।’

তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ ফাঁসির মামলা শুনছেন, তবু মামলার জট আছে। যদি বেঞ্চ বাড়াতে হয়, সে ক্ষেত্রে আরও বিচারপতি দরকার হবে। তাঁর মতে, এ জন্য ফাঁসির মামলা পরিচালনায় দক্ষ আইনজীবীদের মধ্য থেকেও বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের একাধিক সূত্রমতে, গত তিন বছর ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি কম ছিল। এর আগের তিন বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে এর দ্বিগুণের বেশি। এখন ২০১৩ সালের ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি চলছে। ২০১৫ সালের মামলায় পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুতের কাজ চলছে। তবে বেশ কিছু মামলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়েছে, যার মধ্যে দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিকে সবচেয়ে বড় মামলা পিলখানা হত্যা, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আলী হত্যা, নায়রায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন, শিশু রাজীব ও রাজন হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স।

হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের মধ্যে যাঁরা ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ, তাঁদের সংখ্যা যদি বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। প্রথম আলো