বেল্লাল হোসাইন

বিজ্ঞাপনে মিথ্যাচার ও বর্ণবাদ : আইনি প্রতিকার কী?

বেল্লাল হোসাইন : 

একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ” বিজ্ঞাপন হচ্ছে বৈধ মিথ্যাচার। ” কিন্তু মিথ্যা কেন বৈধ হবে? বিজ্ঞাপন কোনো চুক্তি নয়, ইহা ইনভাইটেশন টু ট্রিট। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মামলায় ইনভাইটেশন টু ট্রিট গ্রহণ করার ফলে তা চুক্তিতে রূপান্তরিত হবার নজির আছে।

১৮৯২ সালের কার্লিল ভার্সেস কার্বলিক স্মোক বল কোম্পানি মামলায় ইনভাইটেশন টু ট্রিটকে চুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

ব্যবসায় পরিকল্পনায় বিজ্ঞাপনকে জ্ঞানগত প্রতিবন্ধকতা দূরকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভোক্তাদের কাছে প্রতিনিয়ত বাজারে পণ্যের উপস্থিতির খবর পৌঁছে দিতেই অনবরত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বেগবান করতে তাদের গৃহীত পদক্ষেপে আমাদের কোনো আপত্তি থাকা সমীচীন নয়। তবে গোলটা বাধে তখনই যখন তারা তাদের মুনাফা ও পণ্যের বিস্তার করতে যেয়ে কোনো বিশেষ শ্রেণীপেশার মানুষকে অবমাননা করে। মানুষের জন্ম ও স্থানগত মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে হেয় করে বিজ্ঞাপন প্রচার করার অধিকার তাদের নেই।

১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার আর্টিকেল ২ মতে কোন মানুষকে তার গ্রাত্রবর্ণ, দৈহিক কাঠামো দিয়ে বিভক্তি তৈরি করা যাবে না। বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি অবমাননা করা হয় নারীদেরকে। সবচেয়ে কুরুচিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপন গুলোর মধ্যে রয়েছে ফেয়ারনেস ক্রিম ও হেলদি ডায়েটের বিজ্ঞাপন। হরলিকস এর একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল একদল শিশুকে হরলিকস খাওয়ানো হয়েছিল, অন্যদলকে হরলিকস খাওয়ানো হয় নাই ল্যাব টেস্টে প্রমাণ করার জন্য যে যারা হরলিকস খায় তারা টলার, স্ট্রংগার ও শার্পার! তাহলে যে শিশুদের হরলিকস না খাইয়ে অপুষ্টিতে ভোগানো হলো তার প্রতিকার কী হবে? ভারতের পিয়ার্স সাবানের বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল সোনালী ত্বককে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে! সোনাটা গাড়ির বিজ্ঞাপনে মহিলাদের অদক্ষ ও দূর্ঘটনাপ্রবণ চালক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এগুলো স্পষ্টত মানবাধিকারের লংঘন। বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপন হচ্ছে ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিমের বিজ্ঞাপন। বার মাসই তারা তাদের মনে ময়লা নিয়ে বিভিন্ন ফর্মুলার রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হয়। তারা বিভিন্ন সিজনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেখায় কালো রংয়ের মেয়েরা চাকুরী পায় না, মোটা ও তথাকথিত অসুন্দর মানুষদের অথর্ব হিসেবে উপস্থাপন করতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফর্সাকারী ক্রিম মেখেই বাস্তবে সফল হয়ে যাওয়া লোকের সংখ্যা কত তা ভেবে দেখতে হবে। তবে ব্যক্তিক গুনাবলি ও মেধার প্রয়োগে যে অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র আলোকিত করেছে তা আমরা সহজেই হামেশা দেখে থাকি। তাহলে কেন এই হীনমন্যতায় ভোগানোর প্রবণতা? শুধু ব্যবসার মুনাফার জন্য এই বিভেদ বাড়ানো বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের একটি বড় অংশকে হেয় করা মেনে নেয়া কষ্টকর।

বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক মানবাধিকার অধ্যায়ের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। ”

যেখানে রাষ্ট্র নিজে তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়ায় অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে সেখানে বেনিয়াশ্রেণী কোন ক্ষমতায় এমন অবমাননা করে থাকে তা চিন্তার বিষয়।

এসবের আইনি প্রতিকার কী?

পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা জনস্বার্থে মামলা করা যায়। অতীতেও এমন মামলা হয়েছে। মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হলে অন্যান্য আইনে সাধারণ প্রতিকার না থাকলে রিট করা যায়। সংবিধানের  ৪৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ” এই ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করিবার জন্য এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করিবার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হইল। ”

আইনি প্রতিকারের বাহিরে এসব মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। মিথ্যুক ব্যবসায়ীদের পণ্য বর্জন হতে পারে প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র।

লেখক : শিক্ষানবিস আইনজীবী ও সমাজকর্মী। ই-মেইল : bellal.sincere@gmail.com