সচিবালয়

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত আইন শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠছে

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে নতুন আইন করছে সরকার। এরই মধ্যে আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। শিগগির এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদনের পর যাচাই-বাছাই শেষে আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানায়।

তবে এ-সংক্রান্ত আইন পাসের আগেই বহু দণ্ডিত ও অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনে দণ্ডিত বা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি ক্রোক ও বাজেয়াপ্ত করার বিধান নেই। তবে কারান্তরীণ বা পলাতক যুদ্ধাপরাধীরা যাতে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে উদ্যোগ নিয়েছে আইসিটির তদন্ত সংস্থা।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে বিভিন্ন দল গঠন করে তারা ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সে সময় সাধারণ মানুষের ধনসম্পদও লুট করা হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আরও ২৬ জনের ফাঁসি ও যাবজ্জীবনের রায় আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শুধু সাজা নয়, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও দাবি ওঠে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে।

রাজাকার শিরোমণি জামায়াত আমির প্রয়াত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীন সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় একাত্তরে গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি অপরাধী দল হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তোলা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর পর প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনো আইন হয়নি।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য আইনি কাঠামো তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কাজ গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে। এখন এটা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

আইসিটি আইনে দণ্ডিত বা পলাতক আসামির সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে কিছু বলা নেই। প্রচলিত আইনেও রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সম্পত্তি ক্রোক বা বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। সরকারের হাতে এসব ক্ষমতা না থাকায় সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রচলিত আইনে আসামিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করাসহ সম্পত্তি ক্রোকের বিধান আছে। আইসিটি আইনে তাও নেই।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ গণমাধ্যমকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তে আইন করা খুবই জরুরি। তার মতে, বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে কোন কোন আসামি সম্পত্তি বিক্রি করেছে, সেটা সরকার খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

প্রচলিত আইনে গ্রেফতার কোনো আসামি ইচ্ছা করলে কারাগারে বসেই কমিশনের মাধ্যমে তার সব সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। নিবন্ধন আইনে বলা আছে, খরচ দিলে বাড়িতে বা পছন্দের জায়গায় গিয়ে সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার জমি দলিল করে দিতে পারবেন।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা গোপনে সম্পত্তি বিক্রি করেছে। আইসিটিতে বিচার শুরুর আগে বা পরে চিহ্নিত আসামিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকে গোপনে সম্পত্তি বিক্রি করে দেশত্যাগ করে। পাবনার যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নায়েবে আমির মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মাওলানা আব্দুস সুবহান বিচারের আগেই তার সন্তানদের নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করে। বিচার শুরু ও দেশত্যাগের আগে পিরোজপুরের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার গোপনে কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে। ফরিদপুরের কুখ্যাত রাজাকার পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার তার একাধিক সম্পত্তি বিক্রি করে। কক্সবাজার-মহেশখালীর যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রধান আসামি মৌলভী জাকারিয়া তার সম্পত্তি গোপনে হস্তান্তর করে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আগে বা পরে এবং তদন্ত চলাকালে আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা পরিবারের সদস্যদের নামে হস্তান্তর করে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।

আইসিটির তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়ার পরেও আসামিরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে এসব সম্পদ বিক্রি করেছে। এটা এখনও চলছে। কারাগারে থাকা বা পলাতক যুদ্ধাপরাধীরা যেন তাদের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে জন্য তদন্ত সংস্থা থেকে সম্প্রতি সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মস (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) এবং মানি এক্সচেঞ্জে চিঠি পাঠানো হয়েছে।