খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়ানোর ব্যাখ্যায় যা বললেন হাইকোর্ট

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সোমবার (২৮ জানুয়ারি) প্রকাশ হয়েছে। মামলায় অন্যান্য আসামিদের ১০ বছরের সাজা হলেও বয়স বিবেচনায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাচঁ বছর সাজা দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। পরে আপিলের রায়ে হাইকোর্ট খালেদার শাস্তি বাড়িয়ে অন্য আসামিদের মতো ১০ বছর কারাদণ্ড দেন।

প্রকাশিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি থেকে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়ানোর ব্যাখ্যায় হাইকোর্ট বলেছেন, খালেদা জিয়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা অনুযায়ীও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রধান আসামির শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।

দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। এ ধারায় বলা আছে, কেউ কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির উপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান।

রায়ের পর থেকে কারাবন্দি খালেদাসহ তিন আসামির আপিল এবং দুদকের একটি রিভিশন আবেদনের উপর শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে খালেদার সাজা সর্বোচ্চ ১০ বছর করা হয়।

রায় ঘোষণার প্রায় তিন মাস পর সোমবার (২৮ জানুয়ারি) ১৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

মামলাটিতে খালেদা জিয়াকে মূল অপরাধী অ্যাখ্যা দিয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের বিবেচনায় মূল আসামি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় এ দণ্ডাদেশ (বিচারিক আদালতের দেওয়া পাঁচ বছরের সাজা) যথাযথ হয়নি। বরং প্রধান আসামি হিসেবে খালেদা জিয়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা অনুযায়ীও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।’

‘ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাকে (খালেদা জিয়াকে) সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে যাতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়।’

বিচারিক (নিম্ন) আদালতের দণ্ডের প্রসঙ্গে ধরে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা কম দেয়ার ক্ষেত্রে বয়স, অসুস্থতা ও তার রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করার যুক্তি দেখিয়েছে। মূল আসামিকে সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।’

রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘দুর্নীতি বা অর্থনৈতিক অপরাধ কেবল একটি দেশের সুশাসনের কবরই রচনা করে না, এটি গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে। এটা তর্কাতীত বিষয় যে, দুর্নীতি সব অধিকার কেড়ে নেয়। দুর্নীতি মানবাধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, উন্নয়নকে গিলে খায়, ন্যায়বিচার, সাম্য-স্বাধীনতা-সহমর্মিতাকে তাচ্ছিল্য করে, যা আমাদের সংবিধানে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে।’

রায়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার এতিমের কল্যাণে কাজ করার দায়িত্ব ছিল। সেখানে ভুয়া ট্রাস্ট খুলে আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এতিমের তহবিল পরিচালনা করা হয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করাকে আদালতের কর্তব্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ‘তাই যেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সেখানে অপরাধীদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা মনে করেছি, খালেদা জিয়াকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় সর্বোচ্চ শস্তি দেয়াই হবে যথাযথ বিচার।’

এ মামলায় দণ্ডিত অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ।

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় দুদক এ মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট অভিযোগপত্র দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। অভিযোগে বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আসামিরা আত্মসাৎ করেছেন।

মামলা হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়; তারও চার বছর পর শেষ হয় বিচার।