অ্যাডভোকেট হুমায়ূন কবির

‘মায়ের সম্পত্তি মেয়েরা বেশী পাবে’ এই ধারণাটি ভুল

অ্যাডভোকেট হুমায়ূন কবির :

আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে যে, মায়ের সম্পত্তি মেয়েরা বেশী পাবে। অর্থাৎ মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশী পরিমাণ সম্পত্তির অংশীদার হবে।

ধারণাটি কতটা সঠিক? এর আইনগত ভিত্তিই বা কি? আসুন জেনে নেই বিস্তারিত –

১.
মুসলিম আইনের ফারায়েজের বিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার ছেলে সন্তান মেয়ে সন্তানের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি অবশিষ্টাংশভোগী হিসাবে পায়। এখানে পিতার সম্পত্তি অথবা মাতার সম্পত্তি বলতে আলাদা কোন বিধান নেই। পিতা মারা গেলে তার সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে যেভাবে বণ্টন করা হবে মাতার সম্পত্তি ও সেই একই পদ্ধতিতে বণ্টন করা হবে।

মুসলিম ফারায়েজের সম্পত্তি বণ্টনের সকল পর্যায়ে সমস্তরের পুরুষ মহিলাদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়। দুটি ক্ষেত্রে মহিলা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাওয়ায় ওমরিয়াতান নীতি প্রয়োগ করে পুরুষের অংশ দ্বিগুণ করা হয়েছে।

যেমন – কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার পিতা + মাতা + স্বামী / স্ত্রীর কেউ জীবিত থাকলে স্বামী ১/২ অংশ, মাতা ১/৩ অংশ এবং পিতা অবশিষ্টাংশ ভোগী হিসেবে ১/৬ অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসার ১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে প্রত্যেক পুরুষ মহিলাদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে। উল্লেখিত উদারণে দেখা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তির মাতা পিতার চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাচ্ছে। পবিত্র কুরআনের বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য ওমরিয়াতান নীতি প্রয়োগ করে স্বামী ১/২ অংশ, মাতা ১/৬ অংশ এবং পিতা ২/৬ অংশের বিধান করা হয়েছে।

২.
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী কোন পুরুষ মারা গেলে তার সম্পত্তির উপর প্রথমে পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র এবং বিধবার অগ্রাধিকার। এদের অনুপস্থিতিতে পর্যায়ক্রমে কন্যা, দৌহিত্র, পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্রগন সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন।

কিন্তু কোন মহিলা মারা গেলে তার সম্পত্তি বণ্টনের দুটি নিয়ম রয়েছে।

প্রথমত, কোন মহিলা যদি উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তির মালিক হন তাহলে তার মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে যার নিকট হতে পেয়েছিলেন তার নিকট আত্মীয়দের নিকট ফিরে যাবে।

দ্বিতীয়ত, উত্তরাধিকার ব্যতিত অন্য কোনভাবে যদি কোন সম্পত্তির মালিক হন তাহলে সেই সম্পত্তি মালিকানার ধরন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারদের মধ্য বণ্টিত হবে।

এই ধরনের সম্পত্তিকে স্ত্রীধন বলা হয়। স্ত্রীধন চার ভাবে অর্জিত হতে পারে। ১. শুল্ক ২.যৌতুক ৩.অন্বধেয়ক ৪. অযৌতুক।

শুল্ক হল স্বামীগৃহে যাইতে উৎসাহিত করার জন্য দেওয়া উপহার সামগ্রী। কোন হিন্দু মহিলা মারা যাওয়ার পর তার শুল্ক সম্পত্তি পর্যায়ক্রমে (১) ভ্রাতা (২) মাতা (৩) পিতা (৪) স্বামী উত্তরাধিকার হিসাবে এক জনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন পাবেন।

যৌতুক হল কন্যাকে বিবাহের সময় দেওয়া উপহার সামগ্রী। আর অন্বধেয়ক হল বিবাহের পরবর্তী সময় প্রাপ্ত উপহার।

কোন হিন্দু মহিলা মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া যৌতুক এবং অন্বধেয়ক পর্যায়ক্রমে (১) কুমারী কন্যা (২) বাগদত্তা কন্যা (৩) পুত্রবর্তী / পুত্র সম্ভবা বিবাহিত কন্যা (৪) বিবাহিত বন্ধ্যা কন্যা (৫) পুত্র (৬) দৌহিত্র (৭) পৌত্র (৮) প্রপৌত্র উত্তরাধিকার হিসাবে পূর্ববতী জনের অনুপস্থিতিতে পরবর্তী জন পাবেন।

অযৌতুক হল শুল্ক, অন্বধেয়ক এবং যৌতুক ব্যতীত অন্য কোনভাবে অর্জিত সম্পত্তি। কোন হিন্দু মহিলা মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া অযৌতুক সম্পত্তি পর্যায়ক্রমে (১) পুত্র এবং কন্যা মিলিতভাবে (২) পুত্রবর্তী/ পুত্র সম্ভাবা কন্যা (৩) পৌত্র (৪) দৌহিত্র (৫) বন্ধ্যা বিবাহিত কন্যা (৬) সহোদর ভ্রাতা (৭) মাতা (৮) পিতা (৯) স্বামী উত্তরাধিকার হিসাবে পূর্ববর্তী জনের অনুপস্থিতিতে পরবর্তী জন পাবেন।

৩.
সুতরাং মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মায়ের সম্পত্তি মেয়েরা বেশী পাবে এই ধারণাটি ভুল। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে খুবই সীমিত ক্ষেত্রে মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। দীর্ঘদিন যাবত হিন্দু মুসলিম সহবস্থান এবং আইনের অজ্ঞতার কারণে আমাদের সমাজের অনেকেই এই ভুল ধারণাটি পোষণ করেন।

লেখক : আইনজীবী