অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মনির উদ্দিন

বিচারব্যবস্থায় বাংলা ভাষা উপেক্ষিত!

মোহাম্মদ মনির উদ্দিন :

ভাষা ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে। বাংলা ভাষা বিকশিত হচ্ছে। প্রাচীনকালে ভারতে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা বিচারে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে ফার্সি। এরও পরে ফার্সির সাথে বাংলা। ১৭৯৭তে আইন, বিধি, অধ্যাদেশ এবং প্রবিধান বাংলা ভাষায় ভাষান্তর হয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ০৪ মে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আইনের ব্যবহারে অগ্রসর হয়। জেলা আদালতে ফার্সির বদলে বাংলা চালু জনপ্রিয়তা পায়। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৫ সনে ঘোষণা দিয়ে ফার্সিকে বাদ দিয়ে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে তাঁরা স্বীকৃতি দেয়। ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজির ব্যবহার আদালতে চালু হয়ে আজও বিদ্যমান রয়েছে। উপমহাদেশে ১৭৭৪ সনে কলকাতা সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্টার ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।উপনিবেশিক ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য আজ অবধি আছে। সময়ের বিবর্তনে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নিমিত্ত আদালতে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে না। প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধকতে থাকতে পারে বা রয়েছ। অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো দূর করা অসম্ভব নয়। এসব ভেবে-চিন্তেই বাংলাকে আদালতের ভাষা হিসেবে, স্বীকৃতি দিয়ে ন্যায়বিচার কায়েম করার স্বার্থে পুরোপুরি কার্যকর করা সময়ের দাবি। শুধু দাবি নয়, যৌক্তিকও।

দুই.
সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সনের ০৪ নভেম্বর রচিত হয়ে কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ সংবিধানের সাধারণ ঘোষণা: প্রজাতন্ত্রের ‘রাষ্ট্রভাষা’ বাংলা। একথা বাংলাদেশের সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আইনকে মানতে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ বাধ্য। অবজ্ঞা বা না মানার কোনো সুযোগ নেই।বাংলাদেশ সংবিধান পৃথিবীর একমাত্র বাংলা ভাষার সংবিধান।বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ তিন অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা।এই বাংলা ভাষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে ১৯৫২তে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার তরে জীবনদান বাঙালির এক বিরল ঘটনা। যা একদিকে বেদনার অন্যদিকে গৌরবেরও। রক্তদানের মধ্য দিয়েই একাত্তরে জনযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ জীবন উৎসর্গ ও দুইলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে।মুলত স্বাধীনতার বীজ রোপন হয়েছিল ৫২’র ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অগ্নিগর্ভে। এর ফলেই ১৯৫৬ সনে সংবিধানে বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি আংশিকভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ১৯৬২ সনের সংবিধানের ২১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দু, দুই ভাষাকে জাতীয়ভাষা হিসেবে শর্তারোপক্রমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একসময় ১৯৬৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজির সাথে বাংলাকেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। ফলে আইন কলেজেও বাংলা শুরু হয়। কিন্তু বাঁধা-বিপত্তির কারণে বেশিদূর এগোয়নি বলেই আদালতে বাংলার ব্যবহারও স্তিমিত হয়ে যায়।

তিন.
ভাষা হতে স্বাধীনতা। সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা প্রদান করেছে।ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত,স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ এর অধীনে প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রণীত বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) ধারায় স্পষ্টত বলা হয়েছে, “এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস-আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে”।

চার.
দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮ সনের ০৫ নম্বর আইন কার্যকর হয় ১৯০৯ সনের ০১ জানুয়ারি। এই আইনের ১৮ নম্বর আদেশের ০৪,০৫ এবং ০৬ নম্বর নিয়মে সাক্ষীর জবানবন্দীর ভাষা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে-‘বিচারকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সাক্ষীর জবানবন্দী আদালতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে।কোনো সাক্ষীর জবানবন্দী সমাপ্ত হলে তা বিচারককে সাক্ষীর সামনে পাঠ করে শোনাতে হবে। ০৬ নম্বর নিয়মে বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে সাক্ষীর জবানবন্দী তার ব্যবহৃত ভাষা ব্যতীত অপর কোনো ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তা যদি সাক্ষীর বোধগম্য না হয়, তবে লিপিবদ্ধ জবানবন্দী সাক্ষীর ব্যবহৃত ভাষায় তরজমা করে শোনাতে হবে।’ এথেকে বোঝা যায়, দেওয়ানি কার্যবিধির শুরু থেকেই সাক্ষ্যগ্রহণ মাতৃভাষায় আদালতে হচ্ছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এবং সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালে প্রণীত। ১৮৯৮ সনের ফৌজদারি আইনের ৩৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদানকারীর স্বীয় ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে উল্লেখ আছে। ১৮৭২ সনের সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় স্বীকারাক্তি,৩২ ধারায় মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রদানকারীর ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে।না হলে জবানবন্দী অনেকটা মূল্যহীন ।

এছাড়াও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনসভার কার্যক্রম বাংলায় পরিচালিত হলেও আদালতে চলছে ভিনদেশের ভাষা ইংরেজির ব্যবহার।বাংলায় মামলা-মোকদ্দমা দায়ের,সাক্ষ্যগ্রহণ,যুক্তিতর্ক,রায় এবং আদেশ হলে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, বিচারক উপকৃত হবেন একথা বোঝতে পণ্ডিত হওয়া লাগবে না; আমজনতাই যথেষ্ট। দেশের ভাষা বাংলা, বিচারপ্রার্থীদের ভাষা বাংলা, বিচারকগণ ও বিচারকাজে নিয়োজিত সকলেই বাঙালি এবং ভাষা বাংলা। তাহলে কেন আদালতে ভাষা কিংবা বিচার কার্যক্রম বাংলা ভাষাতে হবে না? এ এক সহজ প্রশ্ন। উত্তর হচ্ছে তথাকথিত সংখ্যালঘিষ্ঠ অভিজাত শ্রেণির কায়েমি স্বার্থ না কী অন্যকিছু। ভাবার বিষয় সামষ্টিকভাবে ভাবতে হবে।

পাঁচ.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান ও ১৯৮৭ সালের আইনের বিধান অনুসরণ করছে। নিম্ন আদালতেও অনুসরণ করা শুরু হয়েছিলো।হাশমত উল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায় ৪৪ নম্বর ঢাকা ল’ রিপোর্ট জার্নালে ৩৩২-৩৩৮ পৃষ্টার অনুচ্ছেদ ২০এ প্রকাশিত হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছেন যে,সরকার দেওয়ানি নিম্ন আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয়নি বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে। যে কারণে আজ অবধি বিচারকাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। হচ্ছেও না, কবে হবে এরও কোনো দারাদিশা নেই। এছাড়াও অনুরূপ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারায়ও সাদৃশ্য বিধান বিদ্যমান রয়েছে।ফলে আদালতে বাংলার ব্যবহার কার্যকর করতে দু’আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানদ্বয় পরিবর্তন করা অপরিহার্য ও জরুরি। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাঁধা মনে হয় মনোস্তাত্ত্বিক। সরকার আদালতের ভাষা বাংলা ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে কার্যকর করতে পারে। সরকারের ইচ্ছাই যথেষ্ট।

ছয়.
বাংলা ভাষায় পৃথিবীর প্রায় ৩০কোটি লোক কথা বলে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ১১টি নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা ব্যাতীত শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ বাংলা বলে।পৃথিবীতে ০৮হাজারের মতো ভাষা রয়েছে,মায়েরভাষা বিবেচনায় বাংলা চতুর্থ স্থানে,ভাষিক বিবেচনায় সপ্তমে।বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সংবিধানে ৮ম তপসিলে ১৮টি তালিকাবদ্ধ ভাষার মধ্যে অন্যতম ভাষা বাংলা। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, ডয়েস ভেলে, রেডিও জাপান, চিন আন্তর্জাতিক বেতার থেকে বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে থাকে। কানাডাতে রেডিও চ্যানেলে রেডিও মেট্রো বাংলায় প্রচার হয়। বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ানস ল্যাংগুয়েজ স্টাডিস বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। গ্রেটবৃটেন,আমেরিকা ও ইউরোপের দেশসমুহ থেকে বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে।তাছাড়াও অনলাইন পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পরিসরে বাংলার ব্যাপক ব্যবহার নিত্যদিন অহরহ ক্রমবর্ধমান হারে ক্রমবিকাশ হচ্ছে। বাংলাদেশে আইনও প্রণীত হচ্ছে বাংলায়।তদুপরি কোন কায়েমি স্বার্থে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা আদৌ সম্ভব হচ্ছে না?গোটিকয়েক লোকের জন্যে তো বিচার ব্যবস্থা নয়।অনুধাবণ করতে হবে,বোঝতে এবং বোঝাতেও হবে।গণমানুষের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই আওয়াজ ক্ষীণ! ম্রিয়মাণ! যতদিন আওয়াজ মসনদে কাঁপন ধরাতে পারবে না, ততদিন এই দাবি হয়ত প্রলম্বিত হতেই থাকবে।

সাত.
বিচারপ্রার্থীদের ভাষায় বিচার কার্যক্রম পরিচালিত না হলে,তা কোনোভাবেই ন্যায়বিচার হতে পারে না।একারণেই জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিকেল রাইট-এ উল্লেখ রয়েছে,বিচারপ্রার্থীদের বোধগম্য ভাষায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।বোধগম্য না হলে,দোভাষীর ব্যবস্থা করতে হবে।ইহা তাঁর মানবাধিকার। বাংলাদেশে এর সুস্পষ্ট ব্যত্যয় হচ্ছে।দেশের শিক্ষিতজনদের কিছুসংখ্যক লোকের নিকট ইংরেজি বোধগম্য, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগনের বোধগম্য নয়। যা জনগণের সাথে এক ধরণের পরিহাস। বাংলাদেশে বিচারপ্রার্থী, বিচারক, আইনজীবী, আদালতে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলেই বাঙালি ও বাংলা ভাষা জানা লোক। আদালতে বাংলা ভাষা ছাড়া পরদেশী ভাষা ব্যবহৃত হবে, যুগের পর যুগ মেনে নেওয়া যায় না। যা স্বাধীনদেশের জন্যে সত্যিকার অর্থে অবমাননাকর। দেশের আদালতে জনগনের ভাষা ব্যবহার না হওয়া মানে এক ধরণের অপমানের বিষয় নয় কি?এর জবাব চাইতে হবে, দাবি উত্থাপন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সামান্য কয়েক দিন পুর্বে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার বাংলা একাডেমির একুশে অনুষ্টানে শেখ মুজিবুর রহমান এক ভাষণে বলেন-‘আমি ঘোষণা করছি,আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে,সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন,তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে,সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন,আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে। ‘স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ঘোষণা দেন,’বাংলা হবে দেশের সরকারি ভাষা’। কিন্তু স্বাধীনতার এতবছর পরও তা হয় নি।

আট.
১৯৭২ থেকে ১৯৯৮।মোট ২৬ বছর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে,আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের কোনো নজির নেই।ভাবতে অবাক লাগে!বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই!তবে আশার বিষয় ১৯৯৯ সাল থেকে অন্তত শুরু হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি মামলার রায় বাংলায় দিয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ দেখিয়েছেন। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তাঁর কর্মজীবনে কখনো বাংলা ভাষা ছাড়া রায় ও আদেশ লিখেন নি। তিনি ইতোমধ্যেই সাত হাজারেরও বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন।বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালও বাংলায় ৫০শের অধিক রায় ও আদেশ দিয়েছেন। বিচারপতি কাজী ইবাদুল হক এবং বিচারপতি মো. হামিদুল হক এর দ্বৈতবেঞ্চ ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে প্রথমে বাংলা ভাষায় রায় দেন। মামলাটি ছিলো ‘নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলা। প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি এম আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি জাকির হোসেন, বিচারপতি মো.আশরাফুল কামাল, বিচারপতি শেখ মো.জাকির হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম, বিচারপতি হামিদুল হক প্রমুখ বিচারপতিগণ অনেক রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন এবং এখনও বাংলায় কিছু বিচারপতি চলমান রেখেছেন। সম্মানীয় বিচারপতিগণ বাংলা ভাষায় যথার্থ রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন, বাংলা ভাষা আদালতে ব্যবহার করা সম্ভব।তাহলে অন্যরা পারতে অসুবিধা কোথায়? অর্থাৎ সদিচ্ছার ঘাটতি। মানসিক দৈন্যতাই প্রধান অন্তরায়। এসব বাঁধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধকতা দূর করা জরুরি।

নয়.
পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় মাতৃভাষার প্রকৃত গুরুত্ব যাদের যতো অধিক তাঁরা ততো অগ্রগামী ।স্বভাষার সমৃদ্ধি করেই বিশ্বের জাতিসমূহ অগ্রসর হয়েছে।চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স,নেপাল ইত্যাদি দেশে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে তাঁরা। ভাষা শিক্ষাকে প্রসারিত করেছে। ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমেই সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এসব দেশে বিচার কার্যক্রম তাঁদের মাতৃভাষায় পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রভাষা’ বাংলা।সংবিধানিকভাবে আদালতের ভাষা বাংলা। ফলে আদালতে বাংলা ভাষার পুরোপুরি ব্যবহার চাই।প্রয়োজনে সরকারি ঘোষণা চাই। ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই ভাষার জন্যে মায়াকান্না সারা বছর খবর নেই তা হতে পারে না। এর অবসান কবে হবে?যুগের পর যুগ পার হচ্ছে।আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে যেসব বাঁধা রয়েছে;এর নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেভাবে ২০০৭ সালে ০১ নভেম্বর ১৩০ বছর পর বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছিলো। বিচার ব্যবস্থায় ধাপেধাপে এগিয়ে যেতে হবে দূর আরও বহুদূর ।

লেখক : আইনজীবী