আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ফাইল ছবি)

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সাফল্যের ৯ বছর

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, দেশান্তর, ধর্মান্তরিতকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার ৯ বছর অতিবাহিত হলো। ৯ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারে সফলতাই দেখছেন ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তারা।

বিচার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে-বিদেশে এ বিচার নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা যে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছিল তা দূর করে যুদ্ধাপরাধের বিচারে আলোর মুখ দেখেছে ট্রাইব্যুনাল। সব প্রতিকূলতা দূর করে বিচারে সাফল্যের পাল্লাই ভারি বলে মনে করছেন আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থার সদস্যরা।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউশন টিমের অন্যতম সদস্য প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী গণমাধ্যমকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার ৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমি মনে করি, আমরা শতভাগ সফল।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রথমত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে ধরে যে সমস্যাগুলো ছিল তা দূর করা খুব কষ্টকর ছিল। এমনকি এ আইন সম্পর্কে বুঝতেই পারছিল না ট্রাইব্যুনালসংশ্লিষ্টরা। বিচারের জন্য তৈরি করা নতুন আইন, দালিলিক সাক্ষ্য- প্রমাণ না থাকা, মৌখিক সাক্ষ্যর মাধ্যমে বিচার এ ধরনের অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় কয়েক যুগ পরে এসে বিচারের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতা দূর করে বিচারে সাফল্যের পাল্লাই ভারি বলে আমি মনে করছি।

সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, দ্বিতীয়ত যে সমস্যাগুলো আমরা অতিক্রম করেছি তা হলো- মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতায় থাকার সময় অপরাধের আলামত ও দালিলিক প্রমাণগুলো প্রশাসনিকভাবে গায়েব করা। এসব ওভারকাম করে তদন্ত সংস্থা ও আইনজীবীরা দেশে বিদেশে এ বিচারকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে, এটাও বিচারের জন্য বিশাল একটি সাফল্য।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সব বাধা দূর করে এ বিচার শুরু করা এবং ৯ বছরে ৮৭ জন আসামিকে দণ্ড দেয়া সরকারের বড় সাফল্য।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর বিচার শুরু করার উদ্যোগ নিলে কত ধরনের বাধা বিপত্তি ছিল। অপরাধীদের পক্ষ থেকে বলা হলো ট্রাব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানের না। এ ট্রাইব্যুনাল বিচার শেষ করতে পারবে না। হুমকি ছিল ট্রাইব্যুনালকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার। এসব কারণে, জনমনে একটি নিরাশা কাজ করছিল, সেই নিরাশা ও বাধার পাহাড় টপকিয়ে প্রথম থেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে বিচার শেষ করতে পেরেছে, এটাই বড় সফলতা।

সিনিয়র আইনজীবী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সরকার এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে দেয়নি। দেশের জনগণ ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারীদের বিচার আর বাংলার মাটিতে হবে না। কিন্তু সেই বিচার শেষ করা হয়েছে। তবে, অপরাধীদের বিচার করার জন্য আন্দোলত সংগ্রাম করতে হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। এ যুদ্ধাপরাধের বিচারেও এমন বাধা-বিপত্তি ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার, জেল হত্যার বিচারের পর এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সব বাধা পেরিয়ে আলোর মুখ দেখেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে।

ট্রাইব্যুনালের ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে তদন্ত সংস্থার অন্যতম জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম সানাউল হক বলেন, মানবতাবিরোধীদের বিচারের ৯ বছর শেষে এসে আমাদের ব্যর্থতার চেয়ে সফলতাই বেশি।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর মানবতাবিরোধী অনেক মামলার বিচার কার্যক্রম সুন্দরভাবে শেষ করতে পেরে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। সঙ্গে সঙ্গে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি ছিল তারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

এম সানাউল হক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ থেকে এ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছিল, তাতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। দেশে-বিদেশে এ বিচারের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন শুধু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আড়াই বছর ধরে যে আপিল মামলাগুলোর বিচার আটকে আছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি হলেই বিচারপ্রার্থী ভিকটিম এবং মামলার সাক্ষীরা সন্তুষ্টি নিয়ে মারা যাবে। পরবর্তী প্রত্যাশা এটাই।

সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম ট্রাইবুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর সেটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনাল সচল রয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৩৫টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ঘোষিত সাজার দণ্ডপ্রাপ্ত আসাসির সংখ্যা ৮৭জন।

অন্যাদিকে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণা করার পর এখন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি করা হয়েছে সাতটি আপিল, যার মধ্যে ছয়জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অপর মামলার আসামির মৃত্যুদণ্ড থেকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এখন আরও প্রায় ২৫টি আপিল আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ২৫টি মামলায় ৪০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৮৪৪ জনের বিরুদ্ধে ৭৫৬টি অভিযোগ এসেছে। মোট মামলা ৯৩টি এবং এই মামলার আসামির সংখ্যা ২৯৭ জন।

২০১০ সালে সাতজন প্রসিকিউটর এবং তদন্ত কর্মকর্তা নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন প্রসিকিউটর রয়েছেন ১৪ জন। প্রথমদিকে দেশের বাঘাবাঘা যুদ্ধাপরাধীদের একের পর এক বিচারের আওতায় নিয়ে আসে এ ট্রাইব্যুনাল।

যেখানে সাতটি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতে ইসলামীর দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় রিভিউতে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন। এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।

এদিকে, বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের মামলা। তারা হলেন, জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুস সুবহান, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলাম, সাবেক জাপা নেতা সৈয়দ মো. কায়সার, বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন, জাপার সাবেক এমপি আবদুল জব্বার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজাকার মাহিদুর রহমান প্রমুখ।

ট্রাইব্যুনালের সর্বশেষ চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের মৃত্যুর পর তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এর আগে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিমকে চেয়ারম্যান, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদকে সদস্য করে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

দুইবছর পর ২০১২ সালের ২৩ মার্চ বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন— হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহীনুর ইসলাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ট্রাইব্যুনাল পূর্নগঠন করা হয়। যদিও এখন একটি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে অপর ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম চলছে। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী বিলুপ্ত করে দেয়া অপর ট্রাইব্যুনাল সচল করা হতে পারে।

এ পর্যন্ত ৩৫টি মামলায় ছয়জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। একজনের আমৃত্যু কারাদণ্ড চলছে। এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ২৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যার একটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি)। সূত্র : জাগো নিউজ