অ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী

জঙ্গিবাদ নির্মূলের দাবীতে কাজ করে যাওয়া এক নারী আইনজীবীর গল্প

অ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী। আইন পেশার পাশাপাশি এক সাহসী নারীর নাম। জঙ্গিবাদ নির্মূলের দাবীতে অবিরাম কাজ করে যাওয়া এক আইনজীবীর গল্প। যার লক্ষ্য, জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাদের উজ্জীবিত করা। যেন তারা আগামিতে দেশ ও জাতীর উন্নয়নে রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য অবদান। দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিম সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপনার সচেতনতামূলক প্রচারণা প্রশংসিত হয়েছে, এমন পরিকল্পনা কীভাবে এলো, এক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কি?

অ্যাড. জিনাত সোহানা : ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই সর্বপ্রথম জঙ্গিবাদ নির্মূলের ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দেন। কেননা জঙ্গিবাদ শুধু আমাদের দেশের জন্য নয় সারা বিশ্বের জন্য মহামারী এক আতঙ্কের নাম। তাই এর বিরুদ্ধে কাজ করাটাও আমার জন্য অনেক বেশী চ্যালেঞ্জিং ছিল। বরেণ্য গবেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মাদ এ আরাফাত এর নির্দেশে ‘সুচিন্তা বাংলাদেশ’ এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক হিসাবে আমি ‘জঙ্গিবাদ বিরোধী আলেম-ওলামা ও শিক্ষার্থী সমাবেশ’ এই ব্যানারে প্রোগ্রামগুলো কার্যকর করে থাকি। ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদ বিষয়টি সাংঘর্ষিক। কারন, এখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে অথবা ধর্মের অপ-ব্যাখ্যার মাধ্যমে কিছু দেশদ্রোহী অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে কিংবা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে জঙ্গিবাদের মতো হীন কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদেরকে বিপদগামী করে তুলে। যেমন, মানুষ হত্যা করে ইসলাম কায়েম করা যেখানে রাসুল (সাঃ) আমল থেকে আজ অবধি ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম হিসাবে পরিগণিত। তাই ইসলাম কখনই জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। এখানে আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটা হচ্ছে মানুষকে বুঝাতে হবে মানুষ হত্যা করে কিংবা সমাজে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে কখনই জান্নাতে যাওয়ার সঠিক পথ হতে পারেনা। কোমলমতি শিশুদের কোনপ্রকার বিভ্রান্তির শিকার করতে না পারে তাই আমরা ইসলাম ধর্মের ভ্রাত্বিতের যে বাণীটা রয়েছে সেটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। এই জন্য মাদ্রাসার পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়াম সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও আমাদের কাজ অব্যাহত রেখেছি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল, সম্প্রতি প্রথমবারের মতো জাতীয় সংগীত গেয়েছে চট্টগ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা, এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কি?

অ্যাড. জিনাত সোহানা : শুধু একটি মাদ্রাসায় নয়। ইতিমধ্যে অনেকগুলো মাদ্রাসায় প্রথমবারের মতো জাতীয় সংগীত পড়িয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, দেশের বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা- নানুপুর ওবাইদিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দারুল মা আরিফ মাদ্রাসা। এতে করে অনেক জায়গায় জেলা প্রশাসকরা শুদ্ধভাবে জাতীয় সংগীত পাঠের আয়োজন করছে। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড থেকেও জাতীয় সংগীত পাঠ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও দুঃখ থেকে যায়। কেননা এখনো এমন অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে জাতীয় সংগীত পড়ানো হয়না। কারন জাতীয় সংগীত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলে। কু-শিক্ষা, কুসংস্কার ও দেশের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব নিয়ে আমাদের সন্তানদের বেড়ে তোলা হচ্ছে; এর বাস্তব উদাহরণ সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের পেজে যখন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীত সরাসরি সম্প্রসার করা হয় তার নিচে থাকা মন্তব্যগুলো। এই অবস্থা থেকে আমাদের অতি শিঘ্রই বের হয়ে আসতে হবে অন্যথায় সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

 

ল’ইয়ার্স ক্লাব : একজন নারী হিসেবে জঙ্গিবাদের মতো বড় ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?

অ্যাড. জিনাত সোহানা : আসলে এই সকল স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে মেয়েদের কাজ করা খুব একটা সহজ নয়। এর জঙ্গিবাদের মতো বিষয় তো আরও বেশী কঠিন। জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান সময় প্রাণনাশের হুমকি এসেছে তবু আমি আমার কাজ বন্ধ করিনি। এখনো আমি বুকে অদম্য সাহস রেখে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা, আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষরা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছেন। আমরা যদি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও জাতির অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন, প্রসার ও প্রচারের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন।তার মধ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দাওরায়ে হাদিস সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমান প্রদান করা।এটা ওনার একটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। ধর্মান্ধ মানুষকে কখনো মুক্তি দিতে পারে না। ধর্মপরায়ণতাই মানুষের মুক্তির পথ। জঙ্গিবাদ নির্মূল আন্দোলনে এই একটি বিষয়ই আমি আলোকপাত করতে চেয়েছি। আর একটা বিশেষ বিষয় হচ্ছে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় চেতনাবোধের যে স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বুকে ধারণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭১ সালে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক মঞ্চে আনতে পেরেছেন। বাংলাদেশে আমিই প্রথম নারী, যার কণ্ঠে সর্বপ্রথম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। এটা আমার জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, আপনি কেবল সমাজসেবক ও অধিকার কর্মীই নন, একজন আইনজীবীও। আইনজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কেমন, এই জায়গায় আইনজীবীরা কতটুকু আন্তরিক বলে আপনি মনে করেন?

অ্যাড. জিনাত সোহানা : আইনজীবীদের বলা হয় সোশ্যাল আর্কিটেক্ট। তাই সমাজ বিনির্মাণে, আইন প্রণয়ন এবং আইনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অনেক বিশাল একটা ভূমিকা রয়েছে। হাজার হাজার মামলা হওয়ায় আদালতে সবসময় মামলা ঝট লেগেই থাকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে আইনজীবীদের মামলা করতে হয় তবে কিছু কিছু বিষয় যেমন সামাজিক ও পারিবারিক অনেক বিষয়ই টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব। সে সকল বিষয়গুলোকে আইনজীবীদের মামলায় উপনিত না করে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করাটাই উত্তম। এতে করে আদালতে মামলা ঝট সৃষ্টি হয়না। পরিবার তথা সমাজ উপকৃত হবে। তাই সমাজে আইনজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক বেশী।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আদালত প্রাঙ্গণে নারী আইনজীবীদের কি কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনার পরামর্শ কি?

অ্যাড. জিনাত সোহানা : নারী আর পুরুষ আইনজীবীদের মধ্যে খুব একটা ব্যবধান নেই। কেননা উভয়েই মানুষ। তবে প্রতিযোগিতার দিক দিয়ে নারীরা এগিয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নারী ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল অবস্থানে নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই আমাদের নারীকে নারী হিসাবে না দেখে মানুষ হিসাবে দেখা উচিত। তাহলে প্রতিটি নারী নির্বিঘ্নে কাজ করে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারবে বলে আমি আশা করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

অ্যাড. জিনাত সোহানা : ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম কে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইলো।