অ্যাডভোকেট তানজিম আল ইসলাম

আইনের জটিল বিষয় সহজ ভাষায় লিখে পাঠক নন্দিত যিনি

বাস্তবতা ও জীবিকার তাগিদে এই যান্ত্রিক নগরীতে বসবাস করতে হচ্ছে। শৈশবের দস্যিপনা, সেই তেপান্তরের মাঠ, নদীর কলকল ধ্বনি, খোলা মাঠের মুক্ত বাতাস, সবুজ গাছের ছায়ায় ছায়ায় নিশ্বাসে বয়ে যাওয়া সজীবতা এখনো মনের মাঝে গেঁথে রয়েছে । গ্রামীণ সবুজ পল্লীতে যার শৈশব কেটেছে সেই ব্যক্তির অবস্থান যেখানেই হোক, সে বারেবারে চাইবে তার গ্রামের সবুজ প্রকৃতির মাঝে ফিরে যেতে। তাই আজও আমাকে গ্রাম নিরন্তর আহ্বান করে। যদি কোন সুযোগ থাকতো আমি গ্রামেই ফিরে যেতাম। আমাদের নতুন প্রজন্ম আসলেই দুর্ভাগা। কেননা তাদের বেড়ে উঠা শহরের যান্ত্রিকতার মাঝে তাই তারা জানেনা গ্রামের সরলতা। এইভাবেই গ্রাম বাংলার প্রতি নিজের অদম্য দুর্বলতার সহজ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আইনের জটিল বিষয় সহজ ভাষায় লিখে পাঠক নন্দিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তানজিম আল ইসলাম। যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে লিপিবদ্ধ করেছেন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিম।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : প্রথমেই জানতে চাই আপনার পড়াশুনা ও পেশা জীবনে কবে থেকে পদার্পণ করেন?

অ্যাড. তানজিম : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগর উপজেলায় স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশুনার হাতেখড়ি। তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে অবস্থিত অন্যদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা বি এন (বাংলাদেশ নৌবাহিনী) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করি। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি অনার্স ও মাস্টার্স করে ২০০৮ সালে বার কাউন্সিলের সনদ পাই। তারপর থেকে আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইন বিষয়ে পড়াশুনা করে আইনজীবী হওয়াটা কি আপনার ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন ছিল?

অ্যাড. তানজিম : আইন পড়ার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ছোট বেলা থেকে আমার বেড়ে উঠা। আর এই বেড়ে উঠার মাঝে আমার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। যার ফলে আমার পড়াশুনা কিছুটা ব্যাহত হয়, তাই আর ডাক্তার হয়ে উঠা হয়নি। তবে সেই দুঃসময়ে আমার বাবা বন্ধুর মতো আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আমার বাবা পেশায় একজন আইনজীবী। কিন্তু তিনি কখনই আমাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন কোন বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করেন নি। বরং তিনি বলেছেন, তোমার যে বিষয়ে পড়তে ভালো লাগে তুমি সেটাতে পড়াশুনা করতে পারো, তবে তুমি ইচ্ছা করলে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করতে পারো। বাবা আইনজীবী হওয়ার সুবাদে ছোট বেলা থেকে আইনের বড় বড় বই দেখে এবং বাবার উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় আইন পেশাটা আমার রক্তের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীতে তাই আইন বিষয়ে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্তটা নিই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স পাওয়ার পর আমার উৎসাহটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সর্বপ্রথম বাবার হাত ধরেই আইন অঙ্গনে আমার পদার্পন। আইনের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় আইন বিষয়ের উপর তখন থেকেই জাতীয় দৈনিকগুলোতে লেখালেখি করতাম।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইন বিষয়ে পড়ার পাশাপাশি লেখালেখির উপর আপনার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কারণটা জানতে পারি?

অ্যাড. তানজিম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ২০০৩ সাল থেকে দৈনিক যুগান্তরে আইন আদালত পাতায় লিখা পাঠাতাম এরপর ২০০৭ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন হওয়ার পর ঢাকায় এসে আমি কাজী আব্দুল হান্নান ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আইন-আদালত পাতায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এছাড়াও দৈনিক সমকাল ও ২০০৭ সালে মিজানুর রহমান খানের তত্ত্বাবধানে দৈনিক প্রথম আলোর আইন পাতায় কাজ করি। তখন থেকে লেখালেখির প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইনজীবী হওয়ার পাশাপাশি আপনি আইনের সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন কাজের কথা ল’ইয়ার্স ক্লাব ডটকমের পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলুন, সে সাথে আমরা জানতে চাই আইনপেশা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।

অ্যাড. তানজিম : উল্লেখযোগ্য কাজ বলতে ২০০৮ সাল থেকে যখন আমি ঢাকা বারে সাজু আর হোসেনের জুনিয়র হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু করি তার পাশাপাশি প্রথম আলোর আইন অধিকার পাতার সম্পাদনা করি। ২০১০ সালে ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে আমি ৭ বছরের মতো কাজ করেছি। এইভাবেই আমার আইন পেশায় আসা। ২০১৭ তে আমি নিজের ল’ফার্ম প্রতিষ্ঠা করি।

আর দ্বিতীয়ত আইনপেশা নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে আইন মানে জটিল একটা বিষয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি আইন না বুঝে তাহলে কি করে সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনের সাথে নিবিড় একটা সম্পর্ক রয়েছে। একজন আইনের শিক্ষার্থী হিসাবে সেটা আমি ভালভাবে উপলব্ধি করি। সে থেকে আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে লেখালখির মাধ্যমে আইনের সহজিকরণ প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করি যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। কেননা, আইন জানাটা একটা মানুষের অধিকারের অংশ। অন্তত মানুষের সেবা করার জন্য হলেও আমি আইন পেশার সাথে জড়িত থাকতে চাই এবং ভবিৎষ্যতে একটি ফোরাম বা প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে আইনকে সহজভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পোঁছে দেওয়াটাই আমার স্বপ্ন।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইনের জটিল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় লিখার জন্য আপনি পাঠক নন্দিত। ইতিমধ্যে আইন বিষয়ক আপনার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোর নাম কি এবং কি ধরণের লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে?

অ্যাড. তানজিম : এই পর্যন্ত আমার ৫ টি আইনের বই প্রকাশ পেয়েছে। যার মধ্যে আইনের কথা, আইনের সহজ পাঠ (১ম ও ২য় খণ্ড), আইনি কথোপকথন, বিয়ে তালাক ও জীবনের গল্পগুলো, সর্বশেষে প্রকাশিত হয় পারিবারিক জীবন ও আইন। আমার প্রতিটা বইয়ে সহজ ভাষায় দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও তার আইনি সমাধান তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো ৩৩ জন আইন বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে “আইনের কথোপকথন” বইটি প্রকাশ করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইনজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কতটুকু এবং এই জায়গায় আইনজীবীরা কতটুকু আন্তরিক বলে আপনি মনে করেন?

অ্যাড. তানজিম : আইন পেশা সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক ও সেবামূলক পেশা। আইনজীবীদের কাছে যখন কোন ব্যক্তি সমস্যা নিয়ে আসে সেটা সামাজিক সমস্যা গুলোর বহির্ভূত নয়। তাই একজন আইনজীবী কোন ব্যক্তির সমস্যা সমাধান করে দেওয়া তথা সামাজিক একটা সমস্যা নিরসন করার সমান। পেশার ক্ষেত্রে আইনজীবীরা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সুযোগ বেশী পায়। যেমন আইনজীবীরা জনস্বার্থে যে সকল মামলা করে থাকেন সেটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই করেন। কেননা এতে করে তার কোন অর্থ উপার্জন হচ্ছে না। ২০০৪ সালে আমি একটা রিট করি এই মর্মে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপর যেন কোন নির্যাতন না করা হয়। প্রতিটি আইনজীবীই সমাজের বিনির্মাণে জনস্বার্থে মামলা করে থাকেন। এই জন্যই আইনজীবীদের বলা হয় সমাজ প্রকৌশলী।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আইন পেশায় দক্ষতা অর্জনে নবীন আইনজীবীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?

অ্যাড. তানজিম : নবীন আইনজীবীদের অর্থমুখী না হয়ে শিক্ষামুখী হওয়া উচিত। তাই নবীন আইনজীবীদের প্রতি আমার পরামর্শ হল, ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের সাথে শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করে লেগে থাকো সফলতা আসবেই। কেননা আইন পেশাটা হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাময়িক অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নবীন আইনজীবীরা যেন কাউকে বিভ্রান্ত না করে বরং সঠিকভাবে তাকে সহযোগিতা করলে যেমন একদিকে তার আইন পেশাটা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে শিখা হবে অপরদিকে নবীন আইনজীবীদের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আইন পেশায় দুইটা বিষয় আবশ্যক। একটা হচ্ছে, ইমেজ আর অন্যটা হচ্ছে ইনকাম। আইনজীবীরা যদি ইমেজ ঠিক রাখে তবে ইনকাম আসবেই। আর শুরুতে যদি তরুণ আইনজীবীরা ইনকামের দিকে ঝুঁকে পড়েন তাতে করে তাদের ইমেজ নষ্ট হবে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার ব্যস্ততম সময়ের মধ্য থেকে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পাঠকদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অ্যাড. তানজিম : ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে ও এর সকল পাঠকদের জন্য রইলো আমার অগ্রিম বৈশাখী শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।