অগ্রক্রয় কি, কেন, কিভাবে?
আইন-আদালত (প্রতীকী ছবি)

সম্পত্তির উত্তরাধিকার বনাম বাংলাদেশের হিন্দু নারী

রিচার্ড দত্ত :

হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী নির্বাচন দুইটি মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘দায়ভাগ’ ও ‘মিতাক্ষরা’ এই দুই মতবাদের মাধ্যমে হিন্দু আইনে সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হস্তান্তর হয়ে থাকে। দায়ভাগ পদ্ধতি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে প্রচলিত আছে। দায়ভাগ মতে পিন্ডদানের অধিকারী ব্যক্তি মাত্রই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী। যারা পিন্ড দিতে পারে তারাই মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তির ওয়ারিশ। ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এবং পাকিস্তানে মিতাক্ষরা পদ্ধতি প্রযোজ্য হয়ে থাকে ।

দায়ভাগ মতবাদের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তরে হিন্দু নারীদের প্রতি চরম বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে একজন নারী তার পিতাও স্বামী উভয় সম্পত্তির অধিকার থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। এই মতবাদের ভিত্তিতে মূলত ৪৮ জন পুরুষ ও পাঁচ ধরনের নারীর উত্তরাধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরাধিকার লাভ করে। এরা হচ্ছেন বিধবা কন্যা, মা, পিতামহী, প্রপিতামহী। দায়ভাগ অনুযায়ী এই পাঁচজন শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরাধিকার লাভ করলেও তাদের ক্রমপর্যায় এত দূরে যে এই ক্রমান্বয় পেরিয়ে সম্পত্তির মালিকানা পাওয়া সত্যি দুঃসাধ্য। এই মতবাদ অনুযায়ী পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্রের মধ্যে কেহ জীবিত থাকলে পাঁচজন নারীর মধ্যে কেহই সম্পত্তির কোন অংশ বিশেষ পাবেন না। আর যদি এদের কেউ জীবিত না থাকেন সেক্ষেত্রে উক্ত নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার পান শুধুমাত্র জীবদ্দশায় ভোগ করার জন্য। কতিপয় নির্দিষ্ট কারন ছাড়া তারা এই সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন না

সেই পুরানো আইনে এখনও হিন্দু সম্পত্তি বণ্ঠনের ফলে বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা শুধুমাত্র সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবেই না সাংবিধানিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এইযে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের উত্তরাধিকার আইনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। Hindu Succession Act, 1956 প্রনয়নের মাধ্যমে এখন ভারতীয় হিন্দু নারীরা পুরুষের মতোই সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পাচ্ছে। এই আইনকে সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে আরও সময়োপযোগী করা হচ্ছে। এছাড়াও সম্পত্তি অর্জন বিষয়ক আইন ১৯৩০; উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫; ভূমি আইনে হিন্দু মহিলাদের অধিকার, ১৯৩৭ ইত্যাদি আইন সমূহ ভারতীয় হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার অর্জনে ও হস্তান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ভারত যদি করতে পারে বাংলাদেশ কেন নয়? দরকার সাধারণ মানুষের মতামত ও সরকারের স্বদিচ্ছা। দেশের প্রধান তিন নেত্রীই যখন নারী, দেশ যখন নারী পুরুষের বৈষম্যহীনতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখছে প্রতিটি স্তরে, নিশ্চয় উত্তরাধিকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও যথাযথ প্রয়োগ খুব কঠিন কিছুনা। পাশাপাশি আদিম ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার থেকে হিন্দু সমাজকে বেরিয়ে এসে নুতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই সম্ভব নয়তো নারীর উত্তরাধিকার শুধুমাত্র আইন আর স্বপ্নের মধ্যবর্তী অলীক মাধ্যমে ঘুরপাক খাবে।

লেখক:  আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা