দেউলিয়া আইন

খেলাপি ঋণ আদায়ে পরিবর্তন আসছে দেউলিয়া আইনে

খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য ‘অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩’ ও ‘দেউলিয়া আইন’-এর সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এখন সংশোধনীর এই খসড়ার ওপর মতামত নেয়ার জন্য তা অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। পরে তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে দেয়া হবে বলে জানা গেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, এই বিভাগের একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে একটি টিম খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইন সংশোধনের খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে। খসড়াটি এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে এটি চলতি মাসের শেষে অর্থমন্ত্রীর কাছে বিবেচনার জন্য পেশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদ্যমান ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’ পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই আমরা ২০০৩ সালে প্রণীত ‘অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩’ পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। এই আইনে খেলাপি ঋণের জন্য পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং মামলার বিভিন্ন বিষয় সন্নিবেশ করা আছে। আইনটি সময়ের সাথে আরো যুগোপযোগী কিভাবে করা যায় তার কথা খসড়ায় বলা হয়েছে। একই সাথে দেউলিয়া আইনের কিছু সংশোধনীর বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি।

জানা গেছে, অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৭ অনুচ্ছেদের ‘আপিল ও রিভিশন’ বিষয় নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কাজ করছে। এখানে কয়েকটি সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই আইনের ৪১ (১) বলা আছে, ‘মামলার কোন পক্ষ, কোন অর্থ ঋণ আদালতের আদেশ বা ডিক্রী দ্বারা সংক্ষুব্ধ হইলে, যদি ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণ ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা অপেক্ষা অধিক হয়, তাহা হইলে উপ-ধারা (২) এর বিধান সাপেক্ষে, ৩৪ [পরবর্তী ৬০ (ষাট) দিবসের] মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে, এবং যদি ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণ ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা অথবা তদ্অপেক্ষা কম হয়, ৩৫ [তাহা হইলে পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিবসের মধ্যে জেলাজজ আদালতে আপীল করিতে পারিবেন।] ’

একই অনুচ্ছেদে, ধারা (২)-বলা হয়েছে, ‘আপীলকারী, ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণের ৫০% এর সমপরিমাণ টাকা বাদীর দাবির আংশিক স্বীকৃতিস্বরূপ নগদ ডিক্রীদার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, অথবা বাদীর দাবি স্বীকার না করিলে, জামানতস্বরূপ ডিক্রী প্রদানকারী আদালতে জমা করিয়া উক্তরুপ জমার প্রমাণ দরখাস্ত বা আপীলের মেমোর সহিত আদালতে দাখিল না করিলে, উপ-ধারা (১) এর অধীন কোন আপীল কার্যার্থে গৃহীত হইবে না। ’

(৩) উপ-ধারা (২) এর বিধান সত্ত্বেও ‘বিবাদি-দায়িক ইতিমধ্যে ১৯(৩) ধারার বিধান মতে ১০% (দশ শতাংশ) পরিমাণ টাকা নগদ অথবা জামানত হিসাবে জমা করিয়া থাকিলে, অত্র ধারার অধীনে আপীল দায়েরের ক্ষেত্রে উক্ত ১০% (দশ শতাংশ) টাকা উপরি-উল্লিত ৫০% (পঞ্চাশ শতাংশ) টাকা হইতে বাদ হইবে।’

একই আইনের ধারা (৬) উল্লেখ আছে, ‘আপীল আদালত, আপীল গৃহীত হইবার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে উহা নিষ্পত্তি করিবে, এবং ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে আপীলটি নিষ্পত্তি করিতে ব্যর্থ হইলে, আদালত, লিখিতভাবে কারণ উল্লেখ পূর্বক, উক্ত সময়সীমা অনধিক আরো ৩০ (ত্রিশ) দিবস বর্ধিত করিতে পারিবে?’

জানা গেছে, এই ধারাগুলো ছাড়া আরো কয়েকটি ধারা সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে এই ধারার সাথে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে।

এর আগে দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই গত ৯ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে এক বৈঠকে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি তখন বলেছেন, ‘আমাদের কিছু কিছু আইনে বিচ্যুতি আছে, আমরা সেই আইনগুলো আগে সংশোধন করব। আমাদের খেলাপি ঋণ বিপুলভাবে কমে আসত যদি বিদ্যমান আইন বলবৎ রাখতে পারতাম এবং তা যদি বাস্তবায়ন করতে পারতাম। আইনে কিছু দুর্বলতার কারণে আইনগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি না। আইনের বিভিন্ন ধারায় বা সেকশনে যে দুর্বলতা রয়েছে তা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। তাই আমরা আইনটিকে আবার ‘রিভিজিট’ করার চেষ্টা করছি। এবং অতি দ্রুত সময়ে মধ্যে তা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি আইনে কিছুটা সংশোধনী নিয়ে আসব।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। সেখানে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। একই সময় ঋণ অবলোপন করা হয়েছে আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব ধরলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে দেড় লাখ কোটি টাকা; যা আমাদের জাতীয় বাজেটের এক-চতুর্থাংশ।