আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ

বিচার বিভাগ এখনো পিরামিড আকৃতিতে, সেখানে অনেক বিভাগ কলসি শেইপ হয়ে গিয়েছে

আবদুল্লাহ আল মামুন

বিচার বিভাগের ঘাড়ে প্রায় দশ লাখ মামলা উঠেছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের নামে। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালের নামে আরো অনেক। অথচ বিরোধের কাজ করেছে প্রশাসন।তারা তালিকা করেছে, না হয় খতিয়ান ভুল করেছে। কিন্তু বিচার বিভাগের ঘাড়ে কমবেশি ১৫ লাখ মামলা তুলে দিয়েছে। আবার পৃথক কোর্ট, স্টাফ দেয়নি। আপিলের ফোরাম বানায়নি। কিন্তু চলছে। আমারা চালাচ্ছি। শত শত বিরোধের উৎপত্তি খতিয়ানে ভুল নিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় এসি ল্যান্ডের বদলে ভূমি অফিসে একজন সহকারী জজ বসলে তিনি অনেক বিরোধ শুরুতেই শেষ করতে পারতেন। বিচার প্রার্থী অপ্রাসঙ্গিক অনেক মামলা থেকে রক্ষা পেতো।

নতুন নতুন আইন হয়। কিন্তু সহায়ক স্টাফ বা বিচারকের পদ/সংখ্যা বাড়ে না। বিদ্যমান কাঠামোর উপরেই ন্যস্ত করা হয় নতুন আইনের দায়িত্ব। সুতরাং, ভারাক্রান্ত আদালতগুলো আরো নতুন করে ভার বহনের জন্য প্রস্তুত হন। এই ২টি আইনে নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পরেও উপযুক্ত ব্যক্তি যেমন সম্পত্তি পাননি, তেমনি সরকারও আপিল করতে পারেনি। কারন আপিল ফোরামই নেই। এই দুই মামলার ক্ষেত্রেই কিন্তু রিট চলবে। কিন্তু সেটার ফলাফল কি? আমরা যদি ধরে নেই এই ১০ লাখ মামলা নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে, তাহলে আপিল ফোরাম না বানিয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পাঠানো কি নাগরিকের অধিকার? কেন শুধু শুধু বিচার প্রার্থীকে হাইকোর্ট দেখানো হবে? অন্য কোন কার্যকর প্রতিকার বা ফোরাম না থাকলে রিট করা চলবে। কিন্তু কোন ফোরাম না বানিয়ে আইনের এই ব্যাখ্যা দেওয়া এবং বিচার প্রার্থীকে তা অনুসরন করতে বলা নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার অস্বীকার করার শামিল নয় কি!

এই বিষয়গুলোতে রীট আকারে কত অপ্রয়োজনীয় মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে আমরা কি তার পরিসংখ্যান নিয়েছি? মাননীয় প্রধান বিচারপতি কয়েকদিন আগে বলেছেন – সুপ্রিম কোর্টে নথী রাখার জায়গা নেই। মানুষ সচেতন হলে মামলা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। Efficient বিচার বিভাগ হলো সেই বিভাগ যে দ্রুততম সময়ে ঐ বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা রাখবে। কিন্তু আমরা কি বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি? সক্ষমতা না বাড়িয়ে বরং ভারে ভারাক্রান্ত বিচার বিভাগকে আরো ভার দিচ্ছি নতুন কোন পদ বা আদালত তৈরি না করেই। সুতরাং, এই অসমাপ্ত পরিসংখ্যান নিয়ে চলছে। পরিসংখ্যানে চাপ বাড়ছে।

বিচার বিভাগের কথা বলা হলেই এই দশ লাখ বা তারও বেশি মামলা পরিসংখ্যানে চাপ বাড়াচ্ছে। একই সাথে বিচার বিভাগ কতটুকু অচল হয়ে পড়েছে সেটা দেখাতে এই পরিসংখ্যান এবং এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে একই সাথে নিজেদের ফায়দা নিতে অনেকে ব্যস্ত। কিন্তু বছরান্তে দায়ের করা মামলার চেয়েও বেশি মামলা বিচারকগণ নিষ্পত্তি করেন। কিভাবে করেন সেটা কেউ জানতে চান না। সে পরিসংখ্যান কেউ দেখে না।

ভাবা যায়, বাংলাদেশের সকল সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ নিজ হাতে বা নিজে টাইপ করে রায়, আদেশ লিখেন! কারণ তাদের কারো স্টেনো টাইপিষ্ট নেই। এই পদই নেই। বিচার বিভাগ থেকে বার বার চেষ্টা করা হলেও ফাইল গিয়ে আটকে যায়। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট থেকে চেষ্টা করা হলেও এখনো এই প্রক্রিয়া চলছে। এখন যারা জেলা জজ আছেন তারাও যখন সহকারী জজ ছিলেন তখন শুনতে পেয়েছিলেন অচিরেই স্টেনো টাইপিষ্টের পদ সৃষ্টি করা হবে। সেটা এখনকার সহকারী জজরাও জানতে পারছেন। আশা করা যায় এখনকার সহকারী জজরা যখন ২০ বছর পরে জেলা জজ হবেন তখন নিশ্চয় পরবর্তী সহকারী জজদের এই সুখবর জানাবেন যে, তোমাদের জন্য স্টেনো টাইপিষ্ট পদ হয়ে গিয়েছে। এখন তোমরা দ্বিগুণ কাজ করতে পারবে। রায়, আদেশ দিতে পারবে। দ্বিগুণ মামলা বা তার চেয়েও বেশি নিষ্পত্তি করতে পারবে। আমরা আশা করতে পারি।

বিচারকগন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। রাষ্ট্রের অন্যতম বিভাগ যদি বিচার বিভাগ হয় তবে কেন এই অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে? নিজের পদ নিজে বিচার বিভাগ বাড়াতে পারেনা। সুতরাং, এই বিড়ম্বনা চলছে। এমনকি বাংলাদেশে প্রায় সকল জেলা জজ আদালতের ২য়, ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতগুলোর স্টেনো টাইপিষ্ট নেই। হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে স্টেনো ধার করে কাজ চালানো হচ্ছে। কিভাবে এই বিচারকরা কাজ করেন? পদ কেন বাড়ে না? কেউ জবাব দেয়না। কিন্তু বিচার বিভাগ চলছে।

এত বছরেও আপিল আদলতের খবর নেই। কখন আপিল আদালত হবে? তার উত্তর নেই। বছর শেষে পরিসংখ্যান শুধু বাড়তে থাকে। বিচার বিভাগ এখনো পিরামিড আকৃতি নিয়ে চলছে। যেখানে অন্য অনেক বিভাগ কলসি, কুমড়ো শেইপ এর হয়ে গিয়েছে।

মাত্র ১৭০০ বিচারক কি ১৮ কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত? অবশ্যই না। বিচারক সংখ্যা এবং infrastructural facilities বর্তমান চাহিদার কারণেই দ্বিগুন করা উচিত। অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে সেগুলো বিচার বিভাগকেও দিতে হবে। একজন বিচারক একই সাথে বা পরে ভিন্ন বিভাগে যোগদান করা কর্মকর্তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আর নিজেদের অবস্থা দেখে যেন হীনমন্যতায় না ভোগেন। এটা সমতার বিষয়। বরং, বিচার বিভাগকে সক্ষম করা সহজ এর ছোট আকৃতির কারণে। ভিন্ন ভাবে বিচার বিভাগকে দেখার কোন সুযোগ নেই। বিচার বিভাগ চাইলেই অর্থ সমস্যা দেখা দেয়। বিচার বিভাগের বাজেট হয় প্রাণিসম্পদের চেয়েও কম। বিচারক, বিচারালয়ের যেহেতু এত অর্থ প্রয়োজন নেই সেহেতু বাজেট কম হওয়াই স্বাভাবিক বৈকি! এই অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চয়ই আসবে। আসছে বাজেটে চমক আছে বলে মাননীয় অর্থ মন্ত্রী জানিয়েছেন। আমরা মধ্য অর্থনীতির দেশ হিসেবে এবং বিচার বিভাগ এই অর্জনের অন্যতম অনুসংগ হিসেবে সেই মানের বাজেট চাই, পদ চাই। সমমানের কর্মকর্তাদের যে সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে বিচারকগনকেও সেটি দিতে হবে। আমরা সেটাই প্রত্যাশা করি সদাশয় সরকারের নিকট।

লেখক : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা