শেখ মহিবুল্লাহ হাসান

সব চাইতে কম সুবিধা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করে একমাত্র বিচার বিভাগ

শেখ মহিবুল্লাহ হাসান

‘স্বাধীন বিচার বিভাগের মাত্র ১২ বছর হল। ধৈর্য ধরেন সব হবে।’ এটাকে এভাবে বললে কেমন হয় – ‘স্বাধীন হবার এক যুগ পরও সুযোগ সুবিধার দিক থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে বিচার বিভাগ।’ ১২ বছর আগে কি দেশে বিচার বিভাগ ছিলো না! তার মানে কি সাবালক হবার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে? বিচার বিভাগের অনেক জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের এখন পর্যন্ত গাড়ী সুবিধা নিশ্চিত হয়নি, আবাসন নিশ্চিত হয়নি আর ঐদিকে অন্য সার্ভিসের মধ্য থেকেও নিম্নের কর্মকর্তারা পাচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি!

একজন UNO একটি উপজেলার নির্বাহী অফিসার আর একজন সহকারী বা সিনিয়র সহকারী জজ ও (আর্থিক এখতিয়ার ভেদে ভিন্ন ) একই উপজেলার বিচারিক অফিসার। কার সুবিধা কোথায়! এ নিয়ে কথা না তোলাটাই বরং অস্বাভাবিক।

UNO সাহেবের অফিসে এসি, পাজেরো স্পোর্টস তো পুরাই ফাইভ ষ্টার এর লবি, রোদে গেলে মাথায় ছাতা। আর বিচার বিভাগের অতিরিক্ত জেলা জজ স্যারদের রুমেও এসি নাই, কোথাও গেলে মুড়ির টিন। আমি জজ, সম্মান দেখে এই চাকুরী নিয়েছি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা আমার চলন, বলনে ও কিন্তু সম্মান অনেকখানি নির্ভর করে।

জজ সাহেবদের গাড়িও থাকবে এবং বাইরে গেলে নিরাপত্তার জন্য পুলিশও থাকবে। সম্মানের এইসব পরিপূরক বিষয়গুলোর দিকেও নজর দেয়া উচিত। পাবলিক বাসে কোনো বাদী বিবাদী সাক্ষীর সাথে আসা লাগলে ‘সম্মান’ কোথায় যায়, কোনো অনুষ্ঠানে ঢুকার মুখে আপনাকে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনি কে?’ তখন আপনকে অপ্রস্তুত অবস্থায় বলতে হচ্ছে আমি অমুক জেলার বিচারক , রেসিপশন বলে- আপনার কার্ড দেখান-! কারণ আপনার সাথে কোনো গাড়ি নাই, পুলিশও নাই অথচ পুলিশ থাকলে বা গাড়ি থেকে নামলে কিছু বলা লাগতোনা। এখন ‘সম্মান’ কোথায় গেলো? এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আমার অনেক স্যাররা পড়েছেন। এগুলা বিব্রতকর, সম্মানহানীকর।

সরকার টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায়। যে যার মতো করে সুবিধা নিচ্ছে। আমরাও জনগণের প্রতি সরকারের মেন্ডেট কে সাথে নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি এবং যাবো। আমরা সেরের উপর সোয়াসের চাই নাই। আমরা বেসিক কিছু বিষয় চাইছি। ব্যাংক, মেডিকেল কলেজ চাই নাই। কোনো বৈধ চাওয়া কি অস্বস্তিকর কোন বিষয়? চাওয়ার মতো চাইতে হবে।

সব চাইতে কম সুবিধা নিয়ে সব চেয়ে বেশি কাজ করে একমাত্র বিচারবিভাগ। আমাদের সুযোগ সুবিধা চেয়ে অন্য কোথায় পোস্ট করতে ভয় পাই। সংকোচে, আর অস্বস্তিতে। কারণ মানুষ কিন্তু জানে আমাদের অনেক কিছু আছে। পোস্ট দিলে যদি মানুষ সত্যিটা জেনে যায় তাহলে আমাদের সম্মান কোথায় যাবে তাই আমরা দেইনা।

গত জাতীয় নির্বাচনে – নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে সোনাইমুড়ীতে প্রেত্মাতাদের চাপাতি আর  পেট্রল বোমা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন আমাদের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তখন UNO সাহেব এসি রুমে বসে ফোনে ফোনে কাজ সারছিলেন। কই কোনো UNO তো আঘাত প্রাপ্ত হয়নি। তদন্ত কমিটি টানা ৩০ দিন স্টেশনে ছিল। আমাদের জন্য ডেইলি আলাউন্স এর GO হয়েছিল আজ পর্যন্ত তা হাতে পাইনি। পাবার আশাও ছেড়ে দিয়েছি। তার গাড়ির কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয়েছে। সে যে সিটে বসেছিল চাপাতির কোপে ওই সিটের তুলে বের হয়ে আসছিলো তবুও সে কেন্দ্র বেদখল হতে দেয় নাই । অন্য সার্ভিস এর কেউ এই বীরত্বপূর্ণ কাজ করলে তাকে মেডেল দেয়া হতো। আমার বন্ধু কি পেয়েছে জানিনা।

এবার ৩৮ তম ফাউন্ডেশন কোর্স এর সনদ প্রদানের দিন সবাইকে ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। তারা চেয়ে নিতে পেরেছে। এই জন্য মহামান্য প্রধান বিচারপতি মহোদয়, রেজিস্ট্রার জেনারেল স্যার এবং ডি.জি স্যারসহ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কিছু একটা চাইতে গেলে ‘আমরা বিচারক’, আমাদের কিছু চাইতে হ্য়না, নিষ্পত্তিতে খেয়াল দেয়া উচিত’ এসব কথা অবান্তর। আমাদের কাজই নিস্পত্তি করা । নিস্পত্তির সাথে বা অন্যান্য সুবিধার সাথে এসব চাওয়ার কোনো নেতিবাচক সম্পর্ক নাই। বরং ইতিবাচক সম্পর্ক আছে।

দেশের সেরা মেধাবীরা এই বিচার বিভাগে কাজ করছে। অন্যদের ভাষায় যেসব চাকুরী কেউ মরে গেলেও ছাড়বেনা এমন সব চাকুরী ছেড়ে দিয়ে জুডিশিয়ারিতে এসেছে আমাদের অনেক বড় ভাই, বন্ধু। তারা এসেছে সম্মান এবং বিচার কর্ম বিভাগের প্রতি ভালোবাসা থেকে। এদের এখনো বহু রাস্তা খোলা। কিন্তু এর মানে এই নয় বাকিরা পাবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে থাকবো।

আমরা যারা ‘আমি জজ’ ‘আমি জজ’ ‘আমার কিছু লাগেনা’ তারা আমাদের অবস্থান মসজিদের ইমাম এর মতো করে ফেলছি। উনার পেছনে রাষ্ট্রপতিও নামাজ পরে। কিন্তু কাল সকালে জাস্ট কমিটির ইচ্ছায় উনি নাই। আউট। এই হচ্ছে সম্মানের নমুনা। আপনার গাড়ি , প্রটেকশন না থাকলে আপনি যে সম্মানের কথা বলছেন সেটাও ‘আউট’ হয়ে যাবে। আমি কোনো ব্যক্তি বিষয়ে বলছি না। বলছি বিচারক পদটি নিয়ে। এই পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুবিধা আমরা চাই। অন্য সার্ভিসকে সুবিধা দিতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু সমপর্যায়ের বিচার বিভাগ কর্মকর্তাগনকেও একই সুবিধা দিতে হবে। এমনিতেই একটি জেলার সব জজ সাহেবদের এক জায়গায় আনাতে সরকারের অনেকাংশে খরচ কমে গেছে।

আমরা আশা করবো আসছে বাজেটে আমাদের Additional District Judge, CJM স্যার গণকে Pajero Sport qx, যুগ্ম জেলা জজ স্যার দের premio আর সিনিয়র এবং সহকারী জজ লেভেল এর সবাইকে গাড়ি লোন দেয়া হবে এবং খাস কামরায় এসির ব্যবস্থা করা হবে, e- judiciary করা হবে।

আমরা অত্যন্ত আশাবাদী আমাদের সুযোগ্য Higher Authority আমাদের সব যৌক্তিক চাওয়াই পূরণ করবে। সবাই একসাথে ভালো থাকবো। দেশ, মা, মাটিকে ভালো রাখবো।

লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালি।