সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ
অ্যাডভোকেট সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ

নাবালক সন্তানের হেফাজতকারী বা হিজানাত বিষয়ক আইন ও অধিকার

আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায়, একটি পরিবারে যখন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সাংসারিক জটিলতা সৃষ্টি হয় বা স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদান করে বা স্ত্রী স্বামীকে তালাক প্রদান করে তখন (নাবালক নাবালিকা) সন্তানকে রক্ষণাবেক্ষণ, ভরন-পোষণ ও সকল দায়দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে “কে সন্তানের (নাবালক বা নাবালিকা) দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বা কার হেফাজতে সন্তান থাকবে বা কে সন্তানের ভাল-মন্দ দেখভাল করার দায়িত্ব নিবেন”!। কোনো কোনো সময় দেখা যায় সন্তানের মায়ের কাছে সন্তান হেফাজতে থাকছে আবার কোনো কোনো সময় দেখা যায় সন্তানের বাবার কাছে হেফাজতে থাকছে। তবে এখন প্রশ্ন হল আইনগতভাবে সন্তানের (নাবালক বা নাবালিকা) বাবা বা মায়ের মধ্যে কে হেফাজতে রাখার অধিকারী হবে? বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ

আমাদের দেশে প্রচলিত আইনের মধ্যে “দি ফ্যামিলি কোর্ট অর্ডিনেন্স, ১৯৮৫ (১৮নং) এবং দি গার্ডিয়ান এন্ড ওয়ার্ডস এ্যাক্ট, ১৮৯০” আইনগুলোতে নাবালক বা নাবালিকার হেফাজত বা হিজানাত সর্ম্পকে বলা হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে বলা হয়েছে, ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিতে (পিউর্বাটি) না পৌছা পর্যন্ত সন্তান মায়ের কাছে থাকবে (হানাফী আইন অনুসারে)। উপরোক্ত দুইটি আইনের ভাষ্য মতে, সন্তানের পিতা হচ্ছে আইনগত এবং প্রাকৃতিক (নেচারাল) অভিভাবক যতদিন পর্যন্ত সন্তান (নাবালক বা নাবালিকা) প্রাপ্ত বয়ষ্ক না হয়। যাহা প্রচলিত আইনে ‘‘দি মেজরিটি এ্যাক্ট, ১৮৭৫” এ উল্লেখ রহিয়াছে। তবে মূলতঃ এই ধরনের বিরোধীয় বিষয়গুলোতে সন্তানের কল্যান বা উত্তম স্বার্থের কথা চিন্তা করে আদালত সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে।

ইসলামিক আইন অনুসারে, ‘যদিও সন্তানের শারীরিক হেফাজতের অধিকার মায়ের উপর, তবুও পিতা তার সন্তানের জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োগের মাধ্যমে তার অভিভাবকের অধিকার প্রয়োগ করবে’। যদি কোন কারনে স্ত্রী তার স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয় এর পরও স্ত্রী (মা) তার সন্তানকে হেফাজতে রাখার অধিকারীনি হবে। ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স অনুসারে, মা সন্তানের অভিভাবক নয় যদিও সে চাইলে সন্তানকে হেফাজতে রাখার জন্য দাবী জানাতে পারে। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত। যদি পিতার অবর্তমানে দাদা সন্তানের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয় তখন সন্তানের মাতা চাইলে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সন্তানের কল্যানের জন্য বা সন্তানকে হেফাজতে নেওয়ার জন্য মোকদ্দমা করতে পারে।

“ডাঃ রশিদ উদ্দীন বনাম ডাঃ কামরুন্নাহার” মামলায় আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে ‘নাবালক বা নাবালিকার কল্যানের জন্য যাহা অনুকূল তাহাই করতে হবে’। তবে নাবালকের বা নাবালিকার জন্য কল্যানকর না হলে অভিভাবক নিয়োগ নিষ্প্রপ্রোয়জন। কোন মাতা তার পুত্র সন্তানের বয়স ৭ (সাত) বছর না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তান বয়ঃসন্ধিতে না পৌছা পর্যন্ত সন্তানদের হেফাজত লাভের অধিকারীনি হবে। মাতা সন্তানের পিতা কর্তৃক তালাক প্রাপ্ত হলেও এই অধিকার অব্যাহত থাকবে। ‘‘উলফাত বিবি বনাম বাফাতি” মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত এই যে, ‘সন্তানের মাতা যদি অন্যত্র বিবাহ করে তাহলে শিশুর পিতা সেই হেফাজতের অধিকারী হবে’। মাতা তাহার সন্তানদের হেফাজতে রাখতে পারে তবে তাহা পিতার নিয়ন্ত্রনাধীন হতে হবে। মাতা চাইলে পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সন্তানের উপর নিয়ন্ত্রন ও তত্ত্বাবধান করতে পারবে না। যদি সন্তানের মাতা তাহা করে তবে মাতা সন্তানের হেফাজতের বা হিজানাতের অধিকার হতে বঞ্চিত হবে (খাদিজা বেগম বনাম গোলাম দস্তগীর, ১৯৭৫) এবং মাতা অসৎ চরিত্র সম্পন্ন হলে তাহার সন্তানের হেফাজতের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যায় (পিএলডি, ১৯৬১, লাহোর, ৭৬৪)। ইহা ছাড়া, পিতা যদি সন্তানকে পরিত্যক্ত করে তবে সেহেতু মাতাই হবে সন্তানের সর্বোত্তম হেফাজতকারীনি (পিএলডি, ১৯৬৩ (ডব্লিউ. পি) করাচি, ৬৫)। সাত বছরের কম বয়সের নাবালক এবং নাবালিকার ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিতে পৌছেনি এমন সন্তানের ক্ষেত্রে মাতা যদি হেফাজতে ব্যর্থ হয় তবে সেক্ষেত্রে মহিলা আত্মীয়াগণ সন্তানের হেফাজত লাভের অধিকারীনি হবে। আদালত অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শিশুকে ভরন পোষন করার মত অর্থের অভাবে শিশুর অভিভাবকের ব্যাপারে মহিলার অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে মাতা তালাকপ্রাপ্ত হয়ে অন্য কাউকে বিবাহ করলে মাতামহীকে না দিয়ে শিশুর কল্যানে পিতার হেফাজতে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মহিলা আত্মীয়াগণ শিশু সন্তানের হেফাজত নিতে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে পুরুষ আত্মীয়গণ চাইলে শিশু সন্তানের হেফাজতকারী হতে পারে। শিশুর মাতা সর্বোত্তম হেফাজতকারীনি হবে তাহার বৈবাহিক সময়ে বা তার স্বামীর কাছ হইতে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও (পিএলডি. ১৯৫৯ (ডব্লিউ.পি), লাহোর, ২০৫)।

আমাদের দেশের প্রচলিত আইন, মুসলিম আইন, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স, দি ফ্যামিলি কোর্ট অর্ডিনেন্স, ১৯৮৫, দি গার্ডিয়ান এন্ড ওর্য়াডস এ্যাক্ট, ১৮৯০ এবং আদালতের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত অনুসারে এটাই বলা যায়, একজন নাবালক বা নাবালিকা সন্তানের হেফাজত বা হিজানাত লাভের ক্ষেত্রে পিতার অধিকার থাকলেও পিতার চেয়ে মায়ের প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার বেশি।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট চট্টগ্রাম