অ্যাডভোকেট মো: রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

ভোক্তার আইনি প্রতিকার

ভোক্তা হিসেবে ন্যায্য অধিকার না পেলে বা প্রতারিত হলে আইনী প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, প্রতিকারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায়। আজকে এসব ভোক্তা অধিকার ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন  আইনজীবী মো: রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভোক্তা হিসেবে আমরা ভেজাল পণ্য, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য, পণ্যের গায়ে লেখা মূল্য কেটে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন বা অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রয়, মিথ্যা বিজ্ঞাপন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাসি পঁচা খাবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত খাবার পরিবেশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছি বা ঠকছি। এরকম ভোক্তা হিসেবে ন্যায্য অধিকার না পেলে বা প্রতারিত হলে আইনী প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, প্রতিকারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায়। এসব ভোক্তা অধিকার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো এই লেখায়।

ভোক্তা কারা

আসলে সকল সাধারণ মানুষই ভোক্তা, যিনি কোনো জিনিস বা সেবা ক্রয় করে তিনি হচ্ছেন ভোক্তা। যদি কোনো জিনিস বাকিতে, বা কিস্তিতেও কিনে তবুও সে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতাভুক্ত হবেন। আইনের আওতায় ভোক্তা হলেন ,যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ্য বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন,অথবা আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন অথবা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করেন। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা গ্রহণ করে বা যে ভোগ করে সেই ভোক্তা বা কনজ্যুমার হিসেবে বিবেচিত হবে।

যে আইনে প্রতিকার

ভোক্তাদের আইনী সুরক্ষা দিতে তথা অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এবং অধিকার সংরক্ষণে ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন। উক্ত আইনটির অধীনে আধা বিচারক সংস্থা হিসেবে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর‘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইনানুসারে সার্বক্ষণিক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের জন্য নানারকম কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই অধিদপ্তর।

কখন নিবেন আইনের আশ্রয়

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হলে বা অপরাধ সংঘটিত হলে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে।আর সেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গুলো হলো; নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, জেনেশুনে ভেজালমিশ্রিত পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মিশ্রণ ও বিক্রয় করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাদের প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় ও সরবরাহ না করা, ওজনে বা পরিমাপে কারচুপি করা , বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা , দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা, কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ উৎপাদন করা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয় করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো কাজ করা যাতে সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাত করা, অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানি ইত্যাদি ঘটানো, পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা বা পণ্যের মোড়কের গায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্য, মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ইত্যাদি লেখা না থাকা, আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা লটকিয়ে প্রদর্শন না করা, আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা প্রভৃতি।

কীভাবে নিবেন আইনের আশ্রয়

ভোক্তা হিসেবে ক্ষতির শিকার হলে কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারিত সংক্ষুব্ধ ভোক্তা উল্লেখিত আইনের ৭৬(১) ধারার অধীনে এ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে আইনের আশ্রয় নিতে পারে ।তবে এই অভিযোগটি পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে।অভিযোগ দেয়ার জন্য চাইলে কিছু প্রমাণ ও দেওয়া যাবে। যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন সেটার প্রদত্ত বিল বা পণ্য – সেবার ক্যাশ মেমো এবং যদি দৃশ্যমান জিনিস হয় তাহলে ছবি থাকলে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।অপরাধটি সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কিংবা অধিদপ্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। এতে আপনার নাম, মা ও বাবার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ফ্যাক্স ও ই-মেইল (যদি থাকে) উল্লেখ করতে হবে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট www.dncrp.g.bd থেকে অভিযোগের ফর্মটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন । প্রিন্ট করে তাতে তথ্য ও বিবরণগুলো লিপিবদ্ধ করুন। ফর্মটি পূরণের পর তার একটি ছবি নিতে পারেন অথবা স্ক্যান করতে পারেন যেন লেখা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিলের কাগজটির একটি ছবি নিন মোবাইলে অথবা স্ক্যান করুন। অভিযোগ এবং বিল যদি ছবি থাকে পণ্যের বা সেবার তাহলে তা সংযুক্ত করে ই-মেইল করুন- nccc@dncrp.gov.bd এই ঠিকানায়। যেসব জেলায় অধিদপ্তরের শাখা নেই, সেসব জেলায় এই আইনে মহাপরিচালককে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর ন্যস্ত থাকবে। অথবা সরাসরি ডাকযোগে পাঠাতে পারবেনজাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র, টিসিবি ভবন (৯ম তলা), কারওয়ানৎবাজার, ঢাকা-১২১৫ ঠিকানায়।এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অধিদপ্তরের শাখা কার্যালয় রয়েছে। যেখানে নাই সেখানে জেলা- উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজগুলো করেন।অথবা আপনার জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালকের স্থানীয় অফিসেও অভিযোগ করতে পারবেন একই পদ্ধতিতে।মনে রাখবেন, ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন না করলে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আদায়কৃত জরিমানার অর্থের ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত অভিযোগকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হয়।এ আইনের অধীনে সর্বনিম্ন পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়।এ ছাড়া জরিমানা ছাড়াও ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে স্থগিতও করতে পারে অধিদপ্তর।এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৬৬ ধারা অনুযায়ী একজন ভোক্তা চাইলে অধিকার আদায়ে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারে।

 ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের সাজা

এই আইনের অধীনে ভোক্তা হিসেবে সরাসরি আদালতে কোনো মামলা যায় না। ভোক্তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই অধিদপ্তর তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজন মনে করলে মামলা করবে। অধিদপ্তর অভিযোগটি গুরুতর মনে করলে অভিযোগ দায়েরের ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেটের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে দায়রা জজের আদালতে আপিল করা যাবে। ভোক্তার ক্ষতি যদি আর্থিক মূল্যে নিরূপণযোগ্য হয়, তবে ক্ষতিপূরণ দাবি করেও যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করার সুযোগ আছে। আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়াও পণ্যের প্রতিস্থাপন বা ফেরত দিয়ে পণ্যের দাম ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে শাস্তি হিসেবে ; পণ্যে ভেজাল বা নকল পণ্য উৎপাদন বা বিক্রি করলে কিংবা বিক্রির সময় ওজন বা মাপে কারচুপি করলে এক থেকে তিন বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এ ছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বা অন্য যে কোনো পণ্য বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড হওয়ারও বিধান রয়েছে। তা ছাড়া মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কোনো পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের প্রতারিত করলে এক বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, পণ্য বিক্রয়কারীর পরিমাপক যন্ত্র বা বাটখারা প্রকৃত ওজনের চেয়ে কম হলে এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, পণ্যের মোড়কের গায়ে ওজন, পরিমাণ, উৎপাদন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। এ নিয়ম মানা না হলে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, দোকানে কোনো দৃশ্যমান স্থানে পণ্যের মূল্যের তালিকা ঝুলিয়ে রাখতে হবে; এ নিয়ম না মানলে এক বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা বা তাঁদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জরিমানা আরোপ, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থানীয়ভাবে স্থগিত করতে পারবেন।

আমরা ভোক্তা হিসেবে যারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছি, ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জেনে একটু সচেতন হলেই এর মোকাবেলা করতে পারি। পাশাপাশি প্রত্যেকেরই উচিত উন্নত জীবনমান নিশ্চিতে, নিরাপদ জীবন যাপন করতে নিজেদের অধিকার বিষয়ে সুসংগঠিত ও সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ।

 লেখককলামিস্ট ও আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম; ইমেইল – ll.braihan@gmail.com