ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত নীতির অনুপস্থিতিতে বিচারিক কৌশল

রাজীব কুমার দেব :

১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ফৌজদারি বিচার নিষ্পত্তি সংক্রান্তে একটি মৌলিক পদ্ধতিগত আইন। বিশেষ আইনগুলোও কার্যবিধিতে বর্ণিত বিধিবিধান অনুসারে বিশেষ অপরাধের বিচার নিষ্পত্তির বিধান করেছে। কিন্তু কার্যবিধিতে বর্ণিত পদ্ধতিগত বিধিবিধানের আলোকে একটি ফৌজদারি বিচার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে এমন কিছু আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যার উত্তর পদ্ধতিগত আইনে নেই। তখন বিচারিক কৌশল প্রয়োগ করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। বিচারিক কৌশল কোন বিধিবদ্ধ আইন নয় – ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে Justice, Equity, Good Conscience নীতি প্রয়োগ করে বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

একটি নালিশী দরখাস্ত দায়েরের পর আমলী আদালতের চারটি উপায় থাকে – তদন্ত বা প্রসেস ইস্যু বা এফআইআর দেওয়া বা খারিজ করা। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতিগত নীতি অনুসরণ করবেন তা কার্যবিধিতে অনুপস্থিত। এগুলো নির্ভর করে আমলী আদালতের বিচারিক কৌশলের উপর। যেমন – একটি নালিশী দরখাস্ত দাখিল করা হলে ঘটনার সত্যতা নির্ণয়ের জন্য যদি এমন কিছু তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয় যা আদালতের সামনে অনুপস্থিত তখন তদন্ত, আর অভিযোগকারীর রেকর্ডকৃত জবানবন্দি ও উপস্থাপিত কাগজাদি পর্যালোচনায় ঘটনার সত্যতার প্রাইমা ফ্যাসি পাওয়া যায় তখন প্রসেস ইস্যু আর যখন ঘটনার সত্যতা উদঘাটনের জন্য জি আর মামলার সুযোগ সুবিধেগুলো প্রয়োজন তখন এফ আই ট্রিটের আদেশ আর যখন ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না তখন খারিজ করা হয়।

তদন্তাধীন একটি জি আর মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর পুনরায় রিমান্ড কিংবা একটি সি আর মামলায় অভিযুক্তের রিমান্ড দেওয়া যাবে কিনা কার্যবিধি কিন্তু এই প্রশ্নে নীরব। কার্যবিধিতে রিমান্ড দানের শর্ত বর্ণিত কোন ক্ষেত্রকেই সমর্থন করে না। কিন্তু যে মামলায় পলাতক অভিযুক্ত সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার বা আলামত উদ্ধার বা আবিষ্কৃত তথ্যের সমর্থণে আলামত উদ্ধার কিংবা স্বীকারোক্তিমূলক জবাবন্দিতে এমন কিছু তথ্য এসেছে যার সমর্থণে আলামত উদ্ধারের সম্ভাবনা থাকে তাহলে কার্যবিধিতে আইনি বিধান না থাকলেও অবশ্যই ঘটনার সত্যতা উদ্ধারের জন্য বর্ণিত সকল ক্ষেত্রেই রিমান্ড মঞ্জুর করা যেতে পারে।

একটি সি আর মামলায় তদন্তাধীন পর্যায়ে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা যাবে কিনা কার্যবিধি এই প্রশ্নে নীরব। কিন্তু এই মামলার আই ও যদি অভিযুক্তের গ্রেপ্তারের প্রার্থণা করে দরখাস্ত দাখিল করে এবং নথি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেল যে অভিযুক্ত পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং সে যদি পলাতক হয় তাহলে তদন্তকার্য ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তখন আদালত গ্রেপ্তারের আবেদন মঞ্জুর করতে পারবেন। আবার আই ও দরখাস্ত যোগে আদালতের অনুমতি মূলে গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের প্রার্থণা করলে আদালত তাও মঞ্জুর করতে পারবেন।

একই ঘটনা বিষয়ে একটি সিভিল মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় একটি ফৌজদারি মামলা স্থগিত করা যায় কিনা কার্যবিধি এই বিষয়ে নিরব। তবে সিভিল মামলার ফলাফলের উপর যদি ফৌজদারি মামলার মেরিট নির্ভর করে কিংবা অর্থঋণ আইনের অধীনে যদি সিভিল মামলা দায়ের হয়ে থাকে তাহলে সিভিল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখা যেতে পারে।

গ্রেপ্তার দেখানো দরখাস্তে অভিযুক্তের উপস্থিতি প্রয়োজন আছে কিনা এই প্রশ্নে কার্যবিধি নিরব। তবে ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়ানোর জন্য এবং অভিযুক্ত দরখাস্তে উল্লিখিত মামলায় হাজতে আছে মর্মে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পি ডব্লিউ ইস্যু করে অভিযুক্তের উপস্থিতিতে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে।

যে সকল তদন্তনাধীন সি আর মামলায় অভিযোগকারী গড় হাজির এবং বেশ কয়েকটি তারিখ অতিক্রম হওয়ার পরও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় নাই সে সকল মামলা কিভাবে নিষ্পত্তি হবে তা কার্যবিধিতে বলা নাই। তার অর্থ কি এই মামলা চলতে থাকবে? না, একটু বিচারিক কৌশল প্রয়োগ করে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন তলব করে অথবা তদন্তাদেশ রি-কল করে অভিযোগকারীকে নালিশী দরখাস্তে বর্ণিত সকল সাক্ষীসহ হাজিরার শর্ত দিয়ে নিযুক্তীয় আইনজীবী কে সীন করতঃ একটি সর্ট তারিখ দিলে এবং শর্ত মতে হাজির না হলে মামলা পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়েছেন এই গ্রাউন্ডে সত্যতা পাওয়া যায় নাই মর্মে কার্যবিধির ২০৩ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে মামলা খারিজ করা যায়।

রিভিশনাল আদালত রিভিশনাল ক্ষমতা প্রয়োগ করে ম্যাজিস্ট্রেটের আমলী আদেশ বাতিল বা আমল গ্রহণের নির্দেশনা দিতে পারবে কিনা কার্যবিধি এই প্রশ্নে নিরব। তার অর্থ রিভিশনাল আদালত যখন Further Enquiry এর আদেশ দেন তখন কি ম্যাজিস্ট্রেটের আমলী আদেশ বাতিল হয়ে যাবে? একটি না-রাজী নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন শুনানীতে মাননীয় দায়রা আদালত আমলী আদালত কে Further Enquiry এর আদেশ দিতে পারেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই আমলী আদেশ বাতিল বা নতুনভাবে আমল গ্রহণের আদেশ দান করতে পারবেন না। আমল গ্রহণের মৌলিক নীতি অনুসারে আদি এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতই কেবল আমল গ্রহণ করতে পারবেন এবং কোন রিভিশনাল বা আপীল আদালত আমলী আদালতের আমলী ক্ষমতাকে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। যদিও মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগ রীট এখতিয়ার প্রয়োগ করে ম্যাজিস্ট্রেটের আমলী ক্ষমতা বাতিল বা আমল গ্রহণের নির্দেশনা দিতে পারেন।

কার্যবিধির বিধানমতে সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারা প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু রায় প্রচারের তারিখে প্রসিকিউশন পক্ষ কতেক সাক্ষীসহ হাজির হয়ে রায় প্রচার হতে উত্তোলনক্রমে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লিখিতভাবে প্রার্থনা করেন। এর উত্তর কার্যবিধিতে না থাকলেও বিচারিক আদালত যদি সন্তুষ্ট হন যে উপস্থাপিত সাক্ষী আদালতের প্রসেস পাননি অথবা তিনি মামলার ভাইটেল সাক্ষী তাহলে liberal view প্রয়োগ করে প্রার্থণা মঞ্জুর করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার পথ সুগম হয়।

পরিশেষে পদ্ধতিগত ব্যত্যয় যেমন বিচার প্রক্রিয়াকে ভিসিয়েট করতে পারে তেমনি পদ্ধতিগত নীতির অনুপস্থিতি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এমতাবস্থায় বিচারিক কৌশল প্রয়োগ করে বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমানো যায়৷

লেখক : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, কক্সবাজার।