মো. ফরিদুজ্জামান

পারিবারিক আদালতে দেনমোহর ও খোরপোষের মোকদ্দমা এবং ডিক্রি পরবর্তি জটিলতা

মো. ফরিদুজ্জামান :

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫  এর ০৫ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের মুসলিম নারী তাঁর দেনমোহর ও খোরপোষের প্রার্থনায় দেশের সব সহকারী জজ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। এই আদালতের আর্থিক এখতিয়ার সীমাহীন হওয়ায় যে কোন অংকের দেনমোহর ও খোরপোষের দাবীতে অত্র আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। ১৯৮৫ সালের এই আইন কার্যকর হলেও ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮৮ ধারা ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বলবত ছিলো এবং পারিবারিক আদালতের বাইরে ফৌজদারী আদালতে কোন ব্যক্তি খোরপোষের প্রার্থনায় মামলা দায়ের করতে পারতেন। যাহোক, ৫০ ডি.এল.আর. এর ৪৭ পৃষ্ঠার  পচন রিক্ষি দাস বনামখুকু রানী দাস মামলায়  মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের পর পারিবারিক আদালত পারিবারিক বিষয়াদির বিরোধ  নিষ্পত্তিতে একচ্ছত্র এখতিয়ার অর্জন করেছে।

বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক বাস্তবতায় যৌতুকের দাবীতে নারীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনায় পরিণত হওয়ার ফলে এবং বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্বে পিতৃতান্ত্রীকতার প্রভাব বিদ্যমান থাকায় বিচার ব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতসমূহে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ০৫ ধারায় যে পাঁচটি বিষয়ে মোকদ্দমার অধিকার মহিলাদের ও শিশুদের দেয়া হয়েছে তাঁর মধ্যে দেনমোহর ও খোরপোষের দাবীতে দায়ের করা মোকদ্দমা সবচেয়ে বেশি। শুধু ঝিনাইদহ জেলার ০৬ টি উপজেলার দায়িত্বে যে ০৬ টি পারিবারিক আদালত রয়েছে সেখানে দেনমোহর ও খোরপোষের মোকদ্দমা সবচেয়ে বেশি।

পারিবারিক আদালতসমূহে বিচারপ্রার্থী অধিকাংশ নারী ও শিশু দুস্থ্য ও অসহায় পরিবারের। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির অংশ। আবার নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের নারীরাও দেনমোহর ও খোরপোষের দাবীতে আদালতে আসেন। এই মোকদ্দমা সমূহে বাদী- নারীদের মোকদ্দমা পরিচালনায় দূর্বল অবকাঠামোয় গড়ে ওঠা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস ব্যতীত সরকারি আর কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই। কিন্তু জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে শুধু অবকাঠামোগত সমস্যা ছাড়াও আছে স্থায়ী অফিসারের অভাব। বাংলাদেশ সরকার তাঁর আর্থিক সক্ষমতার অভাবের কারণে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এখনো স্থায়ী অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) নিয়োগ দিতে সমর্থ হয় নি। এখনো প্রায় বেশ কয়েকটি জেলায় সিনিয়র সহকারী জজ বা সহকারী জজবৃন্দ তাঁদের নিয়মিত দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে লিগ্যাল এইড অফিস চালিয়ে যান। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক),  ব্র্যাক লিগ্যাল এইড এর মত কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দুস্থ্য নারী ও শিশুদের আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকেন। কিন্তু সরকারি –বেসরকারি দুই পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

যেহেতু এই নারীরা তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করানোর জন্য নামকরা ও চৌকস আইনজীবী নিয়োগ দিতে সমর্থ হন না, তাই যেসব আইনজীবী তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রায়শই তাঁরা আরজি প্রস্তুতে বেশ দূর্বল হন। এই দূর্বলতার কারণে নারীরা যে প্রকৃত সমস্যার কারণে দেনমোহর খোরপোষ দাবী করে মোকদ্দমা করেন তাঁর সুনির্দিষ্ট কারণ উঠে আসে না। মোকদ্দমা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখা যায় এই ধরনের মোকদ্দমার আরজির সব বক্তব্যই প্রায় এক। শুধু নাম ঠিকানা আর  ঘটনার তারিখ আলাদা এবং আদালতের ঠিকানা আলাদা আর বাকি সব কিছু এক। যখন মোকদ্দমা বিচারের পর্যায়ে আসে তখন বাদীগণ চাইলেও তাঁদের আরজি সংশোধন করতে পারেন না। কারণ পারিবারিক মোকদ্দমা বিশেষ আইনে হয় বলে আরজি সংশোধনের সুযোগ রাখা হয় নি। তবে ৪৭ ডি.এল.আর (১৯৯৫) এর ২৩৫ পৃষ্ঠায় নজরুল ইসলাম মজুমদার বনাম তাহমিনা আক্তার @  নাহিদ মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ন্যয়বিচারের স্বার্থে সাধারন দেওয়ানী মোকদ্দমার মত পারিবারিক আদালতেও আরজি –জবাব সংশোধনের সুযোগ দিয়ে রায় প্রদান করেছেন।

যেহেতু স্বামী-স্ত্রী বিভিন্ন কারণে আর একসাথে থাকেন না তাই প্রায় ক্ষেত্রেই পারিবারিক মোকদ্দমায় ১০ ধারা প্রয়োগে আদালতের মধ্যস্থতায় বিচারপূর্ব নিষ্পত্তি সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাঁর পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদালতের মধ্যস্থতায় বিরোধ মীমাংসা করা সম্ভব হয়। আর যেসব ক্ষেত্রে হয় না সেসব মোকদ্দমা বিচারে নিয়ে সাক্ষ্য নেয়া হয়। এই সাক্ষ্য গ্রহনে পারিবারিক আদালত গুলোকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। দেখা যায় একই বিচারক একই সাথে দেওয়ানী, অর্পিত সম্পত্তি, বাড়ি ভাড়া, অর্থ সম্পর্কিত বিরোধসহ পারিবারিক বিরোধের বিচার করছেন। একই দিনে সাক্ষ্য নেয়ার ক্ষেত্রে বিচারককে বাধ্য হয়ে প্রথমদিন শুনানি করে আবার পরবর্তি তারিখ দেয়া লাগে অনেক দেরি করে। আর তাতে বিশেষ আইনে বিচার হওয়া স্বত্ত্বেও এই ধরনের মোকদ্দমায় চুড়ান্ত রায় পেতে কোন কোন সময় ০৩ বছর কোন কোন সময় ০৫ বছর এমনকি ০৭-০৮ বছরও লেগে যায়।

আরও একটা বিড়ম্বনা এই ধরনের বিচারপ্রার্থীকে সহ্য করতে হয়। যখন বিবাদী সমন পেয়েও আদালতে আসে না অথবা আদালতের প্রসেস সার্ভারদের গাফেলতি অথবা খারাপ মতলবে সমন ঠিকমত জারী হয়ে ফেরত আসেনা তখন মোকদ্দমা একসময় একতরফা সূত্রে নিষ্পত্তি করা হয়। যখন বাদী এই একতরফা সূত্রে ডিক্রি পায় এবং তা প্রকাশ করে তখন অথবা ডিক্রি জারির মোকদ্দমা দায়ের হলে বিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসে। ফলে ডিক্রির পরবর্তি কার্যক্রম স্থগিত করতে আদালত আইনত বাধ্য হন যদি দায়িকের দরখাস্ত মঞ্জুরক্রমে মূল মোকদ্দমায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আবারও আগের মতই সময় লাগে।

পারিবারিক মোকদ্দমা চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ডিক্রি জারির কার্যক্রম শেষ করার মাধ্যমে। তবে জারির কার্যক্রম বিভিন্ন অবস্থার উপর নির্ভর করে শেষ হয়।

প্রথমত, যদি বাদী একমাত্র হন এবং যদি বিয়ে বলবত থাকে তবে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা ছাড়াও আইনানুগ কাল পর্যন্ত বিবাদী খোরপোষ দেবেন। আর যদি ডিক্রি চলাকালে বাদী- বিবাদীর মধ্যে তালাক হয়ে যায় তাহলে  দেনমোহর ও খোরপোষের যে পরিমাণ টাকা ডিক্রি হয়েছে সেই সাথে তালাকের পর ইদ্দতকালীন ০৩ মাসের টাকা পরিশোধসাপেক্ষে মোকদ্দমাটি চুড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হতে পারে যদি না বাদীর কোন নাবালক সন্তান থাকে।

দ্বিতীয়ত, যদি ডিক্রিদার-দায়িক জারির মোকদ্দমা চলাকালে নিজেদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে নেন এবং ডিক্রিদার-দায়িক আদালতে এসে দরখাস্ত দিয়ে জারী মোকদ্দমা আপোষসূত্রে প্রত্যাহারের আবেদন করেন সেক্ষেত্রে আদালত ডিক্রিদারের জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করে জারির মোকদ্দমা চুড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন।

তৃতীয়ত, যদি ডিক্রিদার ছাড়াও নাবালক ডিক্রিদার থাকেন তবে স্ত্রী- ডিক্রিদারের দাবী চুড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেলেও নাবালকদের ভবিষ্যৎ খোরপোষ ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে একরকম এবং মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে আর এক রকম। তবে এখানে দায়িকের স্বীকার করার ব্যাপার আছে। যদি তিনি মূল মোকদ্দমায় বিয়ে অস্বীকার সহ সন্তান অস্বীকার করেন তবে আবার ডি.এন.এ. টেস্টের ব্যাপার জড়িত। বাংলাদেশের আদালতসমূহ এখনও টেকনোলজি ও বিজ্ঞানের সর্বোচ্চব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। পারিবারিক আদালতে সন্তান ও পিতা-মাতার ডি.এন.এ টেস্ট করানোর জন্য খরচ কত, কোথায় করানো উচিৎ, কতদিন লাগবে এই বিষয়গুলো নির্ধারনের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতগুলো বেশ পিছিয়ে আছে। যদি ডিক্রিদার নাবালক পুত্র হয় তবে নাবালক পুত্র ১৮ বছর পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত খোরপোষ পাবে। আর যদি ডিক্রিদার কন্যা হয় তবে সে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত খোরপোষ পাবে। এক্ষেত্রে, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা হয় নি। সেটা হলো নাবালক সন্তানের খোরপোষ বৃদ্ধির বিষয়। যেমন- কোন নাবালকের খোরপোষ ২০০৫ সালের রায়ে ১০০০/- টাকা নির্ধারন করে রায় দেয়া হলো এবং বাৎসরিক হারে না বাড়িয়েই রায় হলো। তখন যদি ঐ নাবালক সন্তান ০১-০২ বছর বয়স্ক থাকে আর ২০১৯ সালে তাঁর বয়স ১৫-১৬ হয় তাহলে কি তাঁর জন্য ১০০০/- খোরপোষ নির্ধারণ যুক্তিসঙ্গত হবে? এক্ষেত্রে ৫৪ ডি.এল.আর. এর ১৭৫ পৃষ্ঠায় কাওছার চৌধুরী বনাম লতিফা সুলতানা মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম  কোর্টের মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বলেন যে, আদালত চাইলে  নাবালকে কে বর্তমানে দেয়া খোরপোষের অতিরিক্ত  খোরপোষ প্রদানের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন।জারির মোকদ্দমাতেই ডিক্রিদারের আলাদা দরখাস্ত প্রদানের মাধ্যমে আগের নির্ধারিত ভবিষ্যৎ খোরপোষের সাথে বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় ন্যয়সঙ্গত পরিমানে খোরপোষ বৃদ্ধির আদেশ দেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে কোন কোন জেলার বারের আইনজীবীদের ভুলে খোরপোষ বৃদ্ধির জন্য আলাদা মোকদ্দমা দায়ের করার নজির দেখা যায় যা অনভিপ্রেত।

ডিক্রি জারির মোকদ্দমা কীভাবে পরিচালিত হবে তা মূল মোকদ্দমার রায়েই বলা থাকে। অনেক বিজ্ঞ বিচারক রায়ে স্পষ্ট করে বলে দেন কীভাবে বিবাদী বাদির ডিক্রির টাকা পরিশোধ করবেন। অনেক সময় বিচারক স্পষ্ট করে কিস্তিতে ডিক্রিকৃত টাকা পরিশোধের সুযোগ দেন। আবার অনেক সময় রায় প্রচারের সময় বিচারক রায় প্রচারের ৩০/৬০/৯০ দিনের মধ্যে মোকদ্দমার সমুদয় অর্থ এককালীন পরিশোধের নির্দেশ দেন। এইক্ষেত্রে ডিক্রিজারীর সময় জারী আদালতকে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ১৭(৫) ধারা অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু দায়িকপক্ষ আদালতে এসে আদালতের রায়ের নির্দেশ  কোনরকম না মেনেই বা ১৭(৫) ধারার বিধান পালন না করেই  ডিক্রিকৃত টাকার মধ্যে ৫০০০/- বা ১০০০০/- টাকা জমা দিয়ে সময়ের প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশের আদালতসমূহ কোনরূপ আইনগত বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে দিব্যি এরূপ দরখাস্ত মঞ্জুর করে জারী মোকদ্দমা চালিয়ে যান। ফলে এমনও দেখা যায় মুল মোকদ্দমায় যেখানে রায় পেতে সময় লেগেছে ০৩-০৫ বছর  সেখানে জারী মোকদ্দমার মাধ্যমে টাকা পেতে ডিক্রিদারের ১০-১৫ বছর লেগে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধানে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ৫২ ডি.এল.আর. (২০০০) এর ১৫৭ পৃষ্ঠায় মোঃ আলমগির বনাম হাবিবা বেগম মোকদ্দমার রায়ে বলেছেন,প্রয়োজন হলে ন্যয়বিচারের স্বার্থে জারী আদালত ডিক্রিকৃত টাকা দায়িকের দরখাস্তের ভিত্তিতে ন্যয়সঙ্গত কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিতে পারেন।

জারী মোকদ্দমা দায়ের হলে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ১৬ ধারার বিধান মোতাবেক আইনগতভাবেপ্রথমেই দায়িকপক্ষকে লেভি ওয়ারেন্ট জারী করার কথা কিন্তু পারিবারিক আদালতসমূহে বাস্তবে দেখা যায় অন্য চিত্র। সেখানে সাধারন মোকদ্দমার মত দায়িকপক্ষকে নোটিশ জারী করা হয়। এই নোটিশ ফেরত আসতে সাধারন মোকদ্দমার মতই সময় লাগে। নোটিশ জারী হয়ে ফেরত আসলে তাঁর পর দায়িক আসে মোকদ্দমায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। কিন্তু পারিবারিক জারী মোকদ্দমায় দায়িক পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন সুযোগ নেই। তিনি শুধু আদালতের রায় কীভাবে পালন করবেন সে বিষয়ে আদালতকে জ্ঞাত করবেন। যদি লেভি ওয়ারেন্ট বিনা জারীতে ফেরত আসে তাহলে আদালত দায়িকের বিরুদ্ধে সাঁজা পরোয়ানা জারী করে আইননির্ধারিত ১৬ (৩বি) ধারা প্রয়োগ করে  দণ্ড আরোপ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যখন দায়িক পক্ষ আদালতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকেন বা ডিক্রির টাকা একবার কিছু দিয়ে ঠিকমত আদালতে আসছেন না বা শুধু সময় নিচ্ছেন টাকা পরবর্তি ধার্য তারিখে পরিশোধের জন্য তখন আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপতারী পরোয়ানা জারী করছেন। কিন্তু আইনের ১৬ ধারা বলে সাঁজাপরোয়ানা দেয়ার কথা।

আর একটা আশ্চর্যের কথা হলো কোন কোন সাঁজা পরোয়ানা প্রাপ্ত আসামীকে সাঁজা থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে জামিন নেয়ার ঐতিহ্য। এই আইনের ১৬ (৩বি) ধারামতে যদি কোন দায়ি্কের নিকট হতে লেভি ওয়ারেন্টের মাধ্যমে ডিক্রিকৃত টাকা আদায় সম্ভব না হয় তাহলে তাকে ০৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করার কথা। যদি সাঁজা খাটার সময়ে সে ডিক্রির আংশিক টাকা পরিশোধ করে তবে আদালত চাইলে তাকে সাময়িক মুক্তি দিয়ে বাকী টাকা পরিশোধের জন্য সময় দিতে পারেন। এক্ষেত্রে, ফৌজদারী আইনে প্রচলিত বেইল বন্ড দিয়ে জামিন চাওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র আদালত সাঁজা পরোয়ানা ফেরত চেয়ে জেলখানা বরাবর একটা মুক্তির ছাড়পত্র পাঠালে ঐ ব্যক্তি মুক্তি পাবেন। কেন জামিন চেয়ে বেইল বন্ড এর জন্য আবার ২০০০-৩০০০/- টাকা দিতে হবে? এই সম্পর্ক বিচারপতি হামিদুল হক তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ডিক্রির টাকা পরিশোধ করলে বা আংশিক পরিশোধ করলে দায়িকপক্ষকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হবে। আবার, কাজী মখলেছুর রহমান তাঁর বই তে উল্লেখ করেছেন যে, কোন বেইল বন্ড লাগবে না শুধু বাকী টাকা পরিশোধের শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হবে।

যদি কোন দায়িক বাকী টাকার মধ্যে কিছু টাকা পরিশোধ করে আবার আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তবে তাকে আবার আনুপাতিক হারে বা ০৩ মাসের সাঁজা দেয়া যাবে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ২০ বি.এল.ডি. (২০০০) এর ৮৪ পৃষ্ঠায় মোঃ সিরাজুল ইসলাম বনাম মাকসুদা আখতার মোকদ্দমার রায়ে বলেন যে,১৬(৩) ধারা অনুসারে প্রতি কিস্তির টাকা দিতে না পারায় আলাদা আলাদা ভাবে তাকে সাঁজা খাটতে হবে।

আর একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পারিবারিক আদালত সমূহ একই সাথে অন্যান্য আইনের অধীনে অনেক রকমের বিরোধের বিচার করে থাকেন যা উপরেই আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তি দেশ ভারতে পারিবারিক বিরোধের নিষ্পত্তি করার জন্য ১৯৮৪ সালে পারিবারিক আদালত আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের ০৩ ধারা মতে প্রত্যেকটি প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি করে পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে আদালত শুধুই পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। ৩১ ডিসেম্বর,২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা ভারতে মোট ৫৩৫ টি পারিবারিক আদালত সক্রিয়ভাবে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে।এই আইনের ০৪ ধারা অনুসারে পারিবারিক আদালতের বিচারক হতে হলে একজন বিচারককে এই সার্ভিসে অন্তত সাত বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে অথবা এই ধরনের আদালতে ০৭ বছরের বেশি সময় ধরে প্র্যাকটিস করছেন এমন কোন আইনজীবী অথবা প্রধান বিচারপতি যেরূপ চাইবেন সেরকম কোন ব্যক্তি হতে হবে। আবার এই আদালত একজন বা দুই জনের সমন্বয়ে গঠিত হবে। যেখানে বিচারক দুইজন হবেন সেখানে একজন প্রিন্সিপাল বিচারক এবং অপরজন অতিরিক্ত প্রিন্সিপাল বিচারক থাকবেন।

বাংলাদশের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই আশ্চর্যজনক যে, বাংলাদেশের নিম্ন আদালতসমূহে যে সব বিচারক দেনমোহর ও খোরপোষ বিষয়ে বিচার করেন তাঁরা প্রশিক্ষন ও অভিজ্ঞতায় ভারতের বিচারকবৃন্দের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। যদিও একথাও প্রাসঙ্গিক যে, যারা বিচারক হিসেবে বর্তমানে নিয়োগ পান তাঁরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগে সনাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত এবং তাঁরা পারিবারিক আইনের তাত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করেই পড়ালেখা শেষ করেছেন সে অর্থে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার আগে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের তুলনায় তাঁদের জন্য পারিবারিক আদালত পরিচালনার ক্ষমতা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আদালতের চৌহদ্দিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাস্তব জ্ঞান তাঁদের অবশ্যই কম তা সবাই স্বীকার করবেন। সেই প্রেক্ষিতে বিষয়টা ভেবে দেখা বাঞ্ছনীয়।  পারিবারিক আদালতের বিরোধের মধ্যে আবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নারী ও শিশুদের দেনমোহর ও খোরপোষের বিরোধ যে বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আদালতগুলো এখনও বিভক্ত। সেকারণে দেনমোহর খোরপোষের মোকদ্দমা পরিচালনা সহ পারিবারিক আদালতসমূহকে সাধারন আদালত থেকে সম্পুর্ণ পৃথক আদালতে পরিণত করলে রায়ের মান ও আদালত পরিচালনাসহ সার্বিক বিচারে মানুষ ন্যয়বিচার পাবেন বলে আশা করা যায়।

তথ্যসূত্রঃ

১.  Justice Mohammad Hamidul Haque, Trial of Civil Suits and Criminal Cases (2015), pp 184-187

২. Md. Mukhlasur Rahman, Model Issues, Orders and Judgements (Civil), (2016),pp 37-38

৩.http://doj.gov.in/other-programmes/family-courts.

৪. ধারা- ০৪, পারিবারিক আদালত আইন, ১৯৮৪ (ভারত)।

লেখক : সহকারী জজ, ঝিনাইদহ