একরামুল হক শামীম

বিচার বিভাগের মামলাজট বনাম মামলা নিষ্পত্তি

একরামুল হক শামীম:

জনগণের টাকায় পরিচালিত হয় বিচার বিভাগ। ফলে জনগণের কাছেই এই বিভাগের দায় সবচেয়ে বেশি। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, বিচার বিভাগের সবচেয়ে শক্তির জায়গা জনগণের আস্থা। তাই, জনগণকেও বিচার বিভাগের সঙ্কটগুলোর বিষয়ে সম্যক অবহিত থাকা উচিত। কেবল মামলাজটের সংখ্যা নয়, বিচার বিভাগের মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও জানা উচিত। প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬৫০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে বিচার বিভাগের জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ হয় ১৮৪৫ কোটি টাকা। মোট বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে বিচার বিভাগের বরাদ্দ মাত্র ০.৩৫২ শতাংশ! আরও ভালো করে হিসাব করলে বিচার বিভাগের বাজেট বরাদ্দ আরও কমে। কারণ আইন ও বিচার বিভাগের বাজেটে নিবন্ধন অধিদপ্তরের বাজেট রয়েছে ২১৪ কোটি টাকা, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের বাজেট রয়েছে ৩০ কোটি টাকা। ফলে আইন ও বিচার বিভাগের বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বাকি থাকে ১৪০৬ কোটি টাকা। সারা দেশের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ২৭৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। দেওয়ানী ও দায়রা আদালতসমূহের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ৪৫৫ কোটি ৯২ লক্ষ ৬০ কোটি টাকা, বিশেষ আদালতসমূহ ও ট্রাইব্যুনালসমূহের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ১১৩ কোটি ২৬ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ২৯৩২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের একটির বাজেটের তুলনা এভাবে দিতে হচ্ছে বলে ক্ষমাপ্রার্থী। তারপরেও যেহেতু জনগণের টাকায় বিচার বিভাগ চলে, তাই জনগণের কাছে বিচার বিভাগের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরা প্রয়োজন। কারণ, সত্যিকারের মূল্যায়ন জনগণের তরফ থেকেই হয়।

বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলতে গেলেই শুরুতেই উপস্থাপিত হয় মামলাজটের বিষয়টি। বলা হয়ে থাকে, বিচার বিভাগ মামলাজটে জর্জরিত। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত ‘১ জানুয়ারি ২০১৯ হতে ৩১ মার্চ ২০১৯ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যানমূলক প্রতিবেদন’ অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫,৮২,৩৪৭। কিন্তু কখনও কি বলা হয়, বিচার বিভাগের মামলার নিষ্পত্তির সংখ্যা কেমন? ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নতুন মামলা দায়ের ও পুনর্জীবিত মামলার মোট সংখ্যা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার ৬ শত ৬১টি। এই সময়ে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিষ্পত্তি করেছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৩ হাজারে ২ শত ৫০টি মামলা। প্রতি বছরে গড়ে ১২ লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কেউ বলতে পারেন, মামলার নিষ্পত্তি আরও বেশি হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে বিচারক সংখ্যা, বিচার বিভাগের অবকাঠামো, বাজেট বরাদ্দ, আদালতকক্ষের সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সামনে রাখতে হবে। অপ্রতুল জনবল, সীমিত অবকাঠামো, জাতীয় বাজেটের ০.৪০ শতাংশ গড় বরাদ্দ নিয়েই বিচার বিভাগকে কাজ করতে হচ্ছে। বর্তমানে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালত মিলিয়ে বিচারক সংখ্যা ১৮০০ এর মতো। ২০০৮ সালের দিকে এই সংখ্যা ১০০০ এর নিচে ছিল। বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য বিচারক সংখ্যা মাত্র ১ জন! অথচ ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যা অনুপাতে বিচারক সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। আইনের মাধ্যমে নতুন নতুন আদালত/ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করা হচ্ছে, কিন্তু একই ব্যক্তিকে বেশ কয়েকটি আদালত/ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। নতুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে হাজার হাজার মামলা দায়ের হলেও তার জন্য এখনও আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়নি! বিচারক স্বল্পতার কারণে একজনকে একাধিক আদালতের দায়িত্ব পালন করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই সব আদালতে সমানভাবে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। আদালতকক্ষের সঙ্কট আরেক মহাসমস্যার নাম! এই সঙ্কটের কারণে বিচারকদের ভাগাভাগি করে এজলাসের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে বিচারপ্রার্থী বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙিক্ষত বিচারিক সেবা থেকে। আদালতগুলোতে সহায়ক জনবলের ঘাটতিও লক্ষণীয়। নতুন ভূমি জরিপ মানেই বিচার বিভাগের উপর কয়েক লক্ষ মামলার বোঝা চাপে! ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২,৯৭,৭০২টি। গত কয়েক বছরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলো কয়েক লক্ষ মামলা নিষ্পত্তি করেছে। এছাড়া ভূমি জরিপ সংক্রান্তে নিয়মিত দেওয়ানী মামলা তো রয়েছেই। এতোসব প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও ১১ বছর ৩ মাস সময়ে ১ কোটি ৩৮ লাখ মামলার নিস্পত্তি একেবারে কম নয়।

বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে মর্মে কথা প্রচলিত রয়েছে। পুরানো আইন, সেকেলে পদ্ধতি, পক্ষগণের অনিচ্ছা, মামলার তদন্তকাজে বিলম্ব, সাক্ষীর অনুপস্খিতিসহ নানাবিধ কারণে মামলা দীর্ঘায়িত হয় সত্য। কিন্তু সকল মামলার ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা হয় না। বর্তমানে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। পরিসংখ্যানই এর পক্ষে কথা বলবে। দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে মোট দেওয়ানী মামলার সংখ্যা ১৩ লক্ষ ২৮ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে ৫ বছরের পুরানো মামলার সংখ্যা ৩ লক্ষ ৪৯ হাজার ৭১৮টি। অধস্তন আদালতগুলোতে মোট ফৌজদারী মামলার সংখ্যা ১৭ লক্ষ ২৫ হাজার ২৭০টি। এর মধ্যে ৫ বছরের পুরানো মামলার সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৬ হাজার ১১৬টি। সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৫৩ হাজার ৮৭০টি। এর মধ্যে পুরানো মামলার সংখ্যা ৫ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৩৪টি। (তথ্যসূত্র: ‘১ জানুয়ারি ২০১৯ হতে ৩১ মার্চ ২০১৯ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যানমূলক প্রতিবেদন’; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা) মোট মামলার ১৯.১৮ শতাংশ ৫ বছরের পুরানো মামলা। বিচার বিভাগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুরানো মামলাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার ৮৭.১৫ শতাংশ। স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমি বিরোধের প্রকৃতি, নতুন নতুন অপরাধের ধরনের কারণে মামলার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া সরকারের লিগ্যাল এইড সেবার কারণে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বিচারপ্রার্থীরও আদালতে অভিগম্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মামলা দায়েরের বিষয়টি বিভিন্ন বছরগুলোতে কমবেশি হলেও মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে (গ্রাফসমূহ দ্রষ্টব্য।

তথ্যসমূহ হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক বিভিন্ন বছরে প্রকাশিত বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যানমূলক প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হয়েছে)।

নিষ্পত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে বিচার বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিচারপ্রার্থীর নিকট ভোগান্তিহীন বিচারসেবা পৌঁছে দেওয়া বিচার বিভাগের পবিত্র কর্তব্য। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আবারও বলতে হয়, গতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আদালত ও আদালতকক্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি, বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন, বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন আবশ্যকীয় শর্ত। কেবল মামলাজটের কথা বলে অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি না করে, মামলার নিষ্পত্তি সংখ্যার কথা বলে আস্থার পরিবেশও সৃষ্টি করা যায়। কে না জানে, আদালতের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হলে সমাজে তার ফলাফল ভালো হয় না।

লেখক : সংযুক্ত কর্মকর্তা (সহকারী জজ), আইন ও বিচার বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।