কাজী শরীফ, সহকারী জজ

কোথায় সেই শিক্ষক, সেই শিক্ষাঙ্গন

কাজী শরীফ:

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের “নিস্ফলা মাঠের কৃষক” বইয়ে জেনেছিলাম তিনি যখন ঢাকা কলেজে পড়াতেন তখন তাঁর ক্লাস করতে নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্রছাত্রীরা চলে আসতো । এ ঘটনা বিচিত্র নয়। জে সি দেব স্যারের ক্ষেত্রেও তাই শুনেছি। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন শাহ আলম স্যারের সংবিধান ক্লাস করে বুঝেছি ক্লাস কাকে বলে। এখন আর তেমন শিক্ষকদের কথা খুব বেশি শোনা যায়না।

হাতে গোনা যে ক’জন শিক্ষক এ তালিকায় আছেন তার মধ্যে সদ্য অবসরে যাওয়া ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার অনন্যই হবেন। তাঁর সাথে দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। এল এল এমে পড়ার সময় ক্লাস থেকে শিক্ষা সফরে সিলেট গিয়েছিলাম আমরা। ওখানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। আমাদের কৈশোরের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী মানুষের সাথে আমাদের দেখা করাটাকে আমরা শিক্ষা সফরের অংশ মনে করেছিলাম। তিনি আমাদের সাথে যে চমৎকার আচরণ করেছেন ও কথা বলেছেন তার তুলনা চলেনা।আমাদের সাথে ছবি তুলতে মাঠে যান ও প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে ছবি তোলেন।তিনি আমাদের সঠিক পথে থাকার পরামর্শ দেন ও বাংলাদেশ নিয়ে অসাধারণ সম্ভাবনার কথা বলেন। এখন অনেকেই শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু তেমন শিক্ষক কই?

আমি নিজেও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম । আমি কখনোই কাউকে বলতাম না বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। বলতাম অফিসে আছি। কারণ শিক্ষকতার মত মহৎ ও বিশাল কাজটি আমি করতে পারতাম বলে কখনোই মনে হতোনা। যতটা না আমি শিক্ষক তার চেয়ে ঢের বেশি চাকুরীজীবী ছিলাম । মাস শেষে আমার মত অনেক শিক্ষকেরই মূল চাওয়া বেতন। এর বাইরেও যে দায়বদ্ধতা আছে তা নিয়ে ক’জনই বা ভাবি? ক্লাস করানো , মিডটার্ম, ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া, কুইজ নেয়া আর ফলাফল ঘোষণা এই ছিলো আমাদের কাজ। ক্লাসের পড়ার বাইরে দুটো কথা বলার চেষ্টা কি করি আমরা?

হয়তো ছাত্রছাত্রী ভাববে স্যারের আজ প্রস্তুতি নেই অথবা নিজেই প্রণোদিত হয়ে বলিনা। এত কিছুর পর সেটা আর শিক্ষকতা হয়না। হয়ে যায় ৯ টা থেকে ৫ টার অফিস। সুতরাং এ পেশা কী কেরানীগিরির চেয়ে আলাদা কিছু! অনেকেতো কেরানীগিরিকে এক কাঠি এগিয়ে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ তাতে জাতি গঠনের দায়িত্ব নেই। এখানে আছে। অদূর ভবিষ্যতে একটি দুর্বল মেরুদণ্ডের জাতি গঠনে নিজের দায়দায়িত্ব এড়ানো কী যাবে! কাক যেমন নিজে চোখ বন্ধ রেখে মনে করে তাকে কেউ দেখছেনা আমাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে । কিন্তু অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে?

অনেকক্ষণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলা হলো। এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি নিজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধযুগ থাকার কারণে এর মোটামুটি অনেক বিষয়ই জানি । এখানে আছে ছাত্ররাজনীতি নামক মোটামুটি অযৌক্তিক একটি প্রপঞ্চ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতির আবেদন কতটুকু তা তর্কসাপেক্ষ। এ নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো। বিশেষত দুই নেত্রী কারাগারে থাকা অবস্থায় তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলো যে অবদান রেখেছে তা এ প্রশ্নকে আরও উস্কে দেয় !

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে অনেক তুচ্ছতম কারণেও মারামারি হয়। এর মধ্যে ট্রেনে বগি দখল, হলে সিট দখল, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া ইত্যাদি অন্যতম। এ মারামারিতে অনেকেই আহত হন। কেউ কেউ নিহত হন। যিনি বা যারা এ কাজটি অত্যন্ত সগৌরবে করেন তিনি বা তারা বহাল তবিয়তে টিকে থাকেন। কখনো কখনো পুরস্কৃতও হন! আর যদি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে খুব তৎপরও হন তাতেও খুনি বা অপরাধীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়না অনেক ক্ষেত্রেই। কোন সময় দৈবক্রমে মামলা হলেও বা গ্রেপ্তার করলেও নিস্পাপ ছাত্র দাবি করে তাকে মুক্ত করে আনার নতুন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

দলীয় মতাদর্শে লালিত, পালিত ও পুরস্কৃত উপাচার্য “পদ” টিকিয়ে রাখার নির্লজ্জতায় ছাত্রকে ছাড়িয়ে আনতে একমতে পৌঁছান । কখনো কখনো ঐ ছাত্রের জামিনদার হতেও তাঁদের দেখা যায় ! এই হল আমার দেশের শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকদের অবস্থা! এর পেছনে শিক্ষকদের অবদানই সিংহভাগ ।

তবে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হল শিক্ষকদের রাজনীতি করতে গিয়ে ছাত্রদের কাজে লাগানো।  অনেকেই শিক্ষক রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী। আমি কখনোই এ বিষয়ে সহমত পোষণ করিনা। বাংলাদেশের অন্য প্রায় সব পেশার মানুষ রাজনীতি করতে পারলে শিক্ষকরা কেন পারবেন না ? আর এ পেশার মানুষদের যেহেতু জানাশোনার গণ্ডি বড় সেহেতু তাদের জন্য রাজনীতি করাটা অধিক যৌক্তিক বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু এক্সট্রা কারিকুলার কাজ করতে গিয়ে তাঁরা আসল কাজ করতে পারছেন কিনা সেটাও বিবেচনায় নেয়া উচিত। আজকাল শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ছাত্রদের ব্যবহার করছে। যা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একজন শিক্ষক যখন তারই ছাত্রকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করান তখন তাঁর কাছ থেকে জাতিকে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তা কিভাবে পেতে পারি?

বেশ কিছুদিন আগে একটা কাজে বের হয়েছিলাম। রাস্তায় দেখি ভয়ানক জ্যাম। বাংলাদেশের রাস্তায় এ এক অতি সাধারণ ঘটনা। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাঁদরঝোলা হয়ে যারা লোকাল বাসে চড়েন তারা জানেন জ্যামের মধ্যে মধ্যদুপুরে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা কেমন! আচমকাই দেখি কিছু ছেলেপুলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিল। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কারো হাতে লাঠি ।কারো হাতে ইটের টুকরো। ভয়ে বুকে কাঁপন ধরে গেল।

ছাত্রজীবনের অনেক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। দেখি সামনে অনেক মানুষের ভিড়।বাসে আটকা পড়ে এ বয়সেই অক্কা পাওয়ার ভয়ে নেমে দেখি ঐ যুবকেরা একজন রিকশাচালককে বেধড়ক পেটাচ্ছে। লোকটি ছেলেগুলোর পায়ের কাছে পড়ে আছে। সন্তানতুল্য ছেলেগুলোকে বাবা বলে বাঁচতে চাইছে। তার গাড়ির কোনকিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষতবিক্ষত তার শরীর ও রুটি রুজির বাহন।  আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ঐ রিকশাচালক তাদের বাসকে সাইড দেয়নি বারবার হর্ন দেয়ার পরও । পরে এ নিয়ে তাদের বাসচালকের সাথে তর্ক হয় সে রিকশাচালকের। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি সাইড দেয় না এমন দুঃসাহস কীভাবে করল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লাগল যখন দেখলাম তারা ঐ চালককে আড়কোলা করে দোকানের পিছনে নিয়ে যাচ্ছে ।

সহস্ত্রাধিক মানুষ নির্বিকার । নির্বিকার আমিও। সবাই নিজেদের বাঁচাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে। সেই হতভাগ্য রিকশাচালক অসহায় চোখে চারপাশ দেখছে। খুঁজছে এমন দুটো চোখ যে কিনা এ লোকটিকে বাঁচাবে। আমার মনে পড়ে গেল হুমায়ুন আহমেদ সাহেবের লেখা ছোটগল্পের কথা। গল্পের নুরা ডাকাত মানুষের পৈশাচিক রুপের পাশাপাশি মানবিক রূপটিও দেখেছে। এ মানুষটি তা দেখল না। মানুষের বিবেকও আজ অন্ধ। আরও অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম তিন চারজন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকের সামনেই ঘটনাটা ঘটছে দেখেও তারা নির্বিকার আছেন। তারা যানজট নিরসনে নিজেদের নিয়োজিত রাখলেন। দেখলেন না একজন অসহায় রিকশাচালক জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমি দেখছিলাম বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নারকীয়তা।

আমি আরো অবাক হলাম দেখে পেছনের বাসে তাদের শিক্ষকরা বসে আছেন ! যারা ঐ গুণধর ছাত্রদের মানসপিতা। তারা এমনভাবে দেখছিলেন দেখে মনে হচ্ছিল টেলিভিশনে রেস্লিং দেখছেন। আমার কাছে ঐ ছাত্রদের একজন ধর্ষকের সমতুল্য মনে হয়েছে। ধর্ষিতা যেমন নিজের সম্মান বাঁচাতে আব্রুর শেষটুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় আর ধর্ষক সমানুপাতিক দৃঢ়তায় ওটা ছিন্ন করতে চায় তেমন একটি অনুভূতির বহি:প্রকাশ আমি ঐ ছাত্রদের মুখে দেখেছি। আসলেই এমন ছাত্ররা ধর্ষক। কিন্তু যে শিক্ষক তার ছাত্রদের এমন আচরণে প্রতিবাদ করলেন না তার পরিচয় কী দিবো! জাতির ভবিষ্যৎকে ক্ষতবিক্ষত ও বিবেককে রুদ্ধ করার জনক তো এরাই !

এমন শিক্ষকের ছাত্র যদি নৈতিক জীবনযাপন না করেন এবং সে শিক্ষক যদি সভা সেমিনারে শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সেটি কি যৌক্তিক হবে? সে শিক্ষকের উচিত ছিল ঘটনার সাথে সাথে সেটি মীমাংসা করা। তিনি সেটা না করে নিরব থেকে ছাত্রকে উৎসাহিত করেছেন।

আমার মনে পড়ে গেল আমার স্কুল জীবনের কথা। আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি । চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার কারণে আমরা তখন বেশ আত্মবিশ্বাসে ভুগতাম। সে কারণেই হোক কিংবা সাময়িক উত্তেজনায় আমার এক বন্ধু স্কুলের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় রিকশার আঘাত পেয়ে রিকশা চালকের গায়ে হাত তুলে। ওর বহুদামি জুতো নষ্ট হওয়ায় সে কাজটি করে। ঐসময় আমাদের ইংরেজি শিক্ষক বোরহান স্যার দেখে ফেলেন। তিনি কালবিলম্ব না করে আমার বন্ধুটিকে কেজিখানেক ওজনের দুটো চড় মারেন সবার সামনে। ও ঘটনা বলতে চাইলে স্যার না শুনেই বলেন রিকশাচালক যাই করুক না কেন তুই ওকে মারলি কেন?

আমি হারিয়ে গেছি আমার ছাত্রজীবনে। আর আফসোস করি এমন বোরহান স্যার পাবো কোথায় ? আমাদের ছাত্ররা জানেনা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অবদান আছে এইসব রিকশাচালক থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগণের। তাদের ঘামের টাকা কর হয়ে সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। যার বেশিরভাগ অংশ খরচ হয় এসব কুলাঙ্গারদের শিক্ষার পেছনে? আর তাতে যখন কোন শিক্ষক উৎসাহ দেন তখন এর চেয়ে অবিচার ও পৈশাচিকতা হয় না!

আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই উপাচার্য অপসারন থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক কাজে ছাত্রদের কাজে লাগান। তারা ভুলে যান একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্র লেলিয়ে দেয়ার পরিণতি কী? তিনি আসলে তাঁর পতনের সিঁড়ি তৈরি করেন। এ ছাত্রই একদিন আপনাকেও একই ভাবে মূল্যায়ন করবে? একটি খারাপ কাজ অনেক খারাপের যে জন্ম দেয় তার জনক হয়ে উঠেন তাঁরাই ! বলে রাখি এ মন্তব্য কিছু শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সবাই এমন নয়, কিন্তু একজনও যদি এমন হন তার দায় বইতে হবে পুরো সমাজকে।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকরা আমাদের হাঁটতে শেখান, আমাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের দেখতে শেখান, আমাদের মহা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের স্বপ্ন দেখান আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের বিশ্বজগত নিয়ে চিন্তা করতে শেখান। যারা আমাদের মনোজগতে ভাবার বীজ বপন করেন তাদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা যেমন বেশি আমাদের প্রতি তাঁদের দায়িত্বও অসীম।

স্যার, আমরা সাধারণ মানুষ । আপনারা এ দেশটির মেরুদণ্ড তৈরি করছেন। আপনাদের কোন অসতর্কতা ও অনৈতিকতা যদি আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে তার দায় কিভাবে এড়াবেন? রবিঠাকুর যেমন বলেন “ দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর” তেমনি আমিও বলি দাও ফিরে সে শিক্ষক, শিক্ষাঙ্গন লও এ তথাকথিত সভ্যতা!

লেখক : সহকারী জজ, নোয়াখালী।