বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক রচিত 'বিচার বিভাগে ৪৫ বছর' বইয়ের প্রচ্ছদ

বিচারপতি হামিদুল হক স্যারের ‘বিচার বিভাগে ৪৫ বছর’ বইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক গতকাল বুধবার (২৬ জুন) পরলোকগমন করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ‘বিচার বিভাগে ৪৫ বছর’ শিরোনামে সদ্য প্রয়াত এই বিচারপতির লেখা বইয়ের নির্বাচিত কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন অ্যাডভোকেট রায়হান চৌধুরী।

আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে তিনি লিখেছেন

* “বিচার বিভাগ অকার্যকর হয়ে পড়লে আইনের শাসন থাকবে না। আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্র থাকবে না। গণতন্ত্র না থাকলে মধ্যযুগে ফিরে যেতে হবে।” -১১০ পৃষ্ঠা

বিচারকও একজন নাগরিক এবং ভোটার

* “বিচার বিভাগ দলীয়করণ সম্পর্কেও কিছু কিছু কথা শোনা যায়। আমি একদিন অবাক হয়ে গেলাম একটি মন্তব্য শুনে। একজন মন্তব্য করেছিলেন যে, অমুক বিচারক দলের বিচারক। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, বিচারকগণের কোন দল থাকতে পারে না । বিচারকও একজন নাগরিক ও ভোটার। কাজেই তাঁর কোন একটি দলের প্রতি দুর্বলতা থাকতেই পারে এবং ভোট দেওয়ার সময় তিনি সেই দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু বিচারকের আসনে বসে বিচার করার সময় কোন দলের কথা মনে রেখে বিচার করা হলে বিচার ব্যবস্থায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে । বিচার বিভাগ যেন এরূপ প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেদিকে সব বিচারকগনের খেয়াল রাখা উচিত।” -১২৪ পৃষ্ঠা

সুবিচার করা খুবই কঠিন

* “আমি নিজেও বিচারকগণ কে প্রভাবান্বিত হতে দেখেছি। সুবিচার করা খুবই কঠিন তবে কোনো মামলায় সঠিক সিদ্ধান্ত তেমন কঠিন নয়। একজন বিচারক যদি নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে একটি মামলার বিষয় বিবেচনা করেন এবং আইনগত বিষয় গুলির উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য একটু পরিশ্রম করেন অর্থাৎ আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও নজির ইত্যাদি জানার জন্য পড়াশোনা করেন তাহলে তার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন হবে না। অবশ্য এরকম চেষ্টা বা পরিশ্রম এরপরেও হয়তো দুই একটা সিদ্ধান্ত বাবুল রায় হতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিক কিন্তু যেনতেন প্রকারে রায় দেওয়া বিষয় বিবেচনায় এনে সমর্থনযোগ্য নয়।” -১২৫ পৃষ্ঠা

পূর্বের চেয়ে বর্তমানে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতার বেড়েছে

*”আমি মানিকগঞ্জে জয়েন করার দিন সকালে ৯ টা ৩০ মিনিটে আমার চেম্বারে দুটি বড় সাইজের মিষ্টি ও এক কাপ চা আমার পিয়ন নিয়ে আসে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম মিষ্টি ও চা কে পাঠিয়েছে। পিয়ন বলল পেশকার সাহেব পাঠিয়েছেন। তখন তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল যে আমার পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর চা নাস্তার ব্যবস্থা পেশকার সাহেব করতেন। আমি তখন পেশকার সাহেবকে ডাকি এবং পরিষ্কার বলে দেই যেন আমার চা নাস্তার কোন ব্যবস্থা না করেন। চাকুরীতে যোগদান করার পূর্বে শুনতাম যে বেশিরভাগ পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়ন, জারীকারক দুর্নীতিগ্রস্ত। আমি দেখলাম এই অবস্থার জন্য কোন কোন বিচারক দায়ী। পূর্বের চেয়ে বর্তমানে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতার আরও বেড়েছে। পূর্বে তারা সাধারণত: বকশিশ হিসেবে পক্ষগণের নিকট টাকা নিত কিন্তু বর্তমানে ফাইল আটকে কিংবা অন্য কোন উপায়ে পক্ষদের চাপের মধ্যে ফেলে টাকা আদায় করা হয় মর্মে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।”- ১৮ নং পৃষ্ঠা।

নির্লোভ ও সততার দৃষ্টান্ত

* “আজ থেকে ৪৫ বছর পূর্বে যখন চাকরিতে জয়েন করি তখন সার্ভিসের ২৩ জন ব্যতীত আর কারো মধ্যে অর্থ সম্পদ অর্জনের প্রবণতা দেখি নাই। এখন দেখি যে, চাকরিতে জয়েন করার পর দিন হতেই কত তাড়াতাড়ি বাড়ি, গাড়ি, দামি টিভি, আসবাবপত্র ইত্যাদি করা যাবে এটাই অনেকের নিকট মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। খুব সম্ভবত ১৯৬৬ সনে এই দেশে প্রথম টিভি চালু হয়। চাকুরী জীবনের ১০ বছর পরে কলম্বোতে ছয় মাসের ট্রেনিংয়ের পর কিছু পাউন্ড Sterling save করে দেশে নিয়ে আসি এবং ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর যে টাকা পাই তাই দিয়ে প্রথম একটি সাদা কালো টিভি কিনি। প্রায় ১২ বছর চাকরি করার পর কম দামি একটি সুপার সেট কিনে এবং প্রায় ১৫ বছর পর একটু পুরনো ফ্রিজ কিনে আরো অনেক পরে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পর আসবা পত্র কিনার জন্য এককালীন ৩০ হাজার টাকা পাই এবং ওই টাকা দিয়ে একটা নতুন Hire purchase ভিত্তিতে একটি রঙ্গিন টিভি কিনি।” – ১২৭ পৃষ্ঠা

লেখক : আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট।