শিক্ষানবিশদের সাম্প্রতিক আন্দোলন প্রসঙ্গ

অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ : 

গতকাল ২৯ জুন, ২০১৯ তারিখে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বার কাউন্সিলের বাংলামোটর অফিসের সামনে। সেখানে খুবই সামান্য উপস্থিতি ছিলো বটে – এটা দেখে মনটা অনেকেরই খারাপ হলেও এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে, শিক্ষানবিশগণ স্বল্প আকারে উপস্থিতি দিয়ে হলেও তাদের দাবিদাওয়াকে সামনে এনে একটি কর্মসূচির যাত্রা শুরু করেছে। ২০১৭ সালের পরীক্ষার আগে এরকম আরো একটি আন্দোলন তৎকালীন শিক্ষানবিশদের একটি সফল আন্দোলন হয়েছিলো। আবার ঐ একই পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষার্থীদের খাতা রিভিউ এর দাবি এবং একবার এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করলে পরবর্তীতে সরাসরি লিখিত পরীক্ষার দাবিতেও একটি ভালো এবং সফল আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। লিখিত পরীক্ষা সংক্রান্ত বেশ শক্তিশালী আন্দোলনের মুখে বার কাউন্সিল তাদের দাবির প্রধান অংশ মেনেও নিয়েছিলো।

কিন্তু এবারের শিক্ষানবিশগণ আরেকটি আন্দোলন গড়ে তুলছেন – তার প্রধানতম দাবি হলো প্রতি বছর বছর পরীক্ষা নেবার যে বিধান বার কাউন্সিল আইনে রয়েছে সেটি যেন নিয়মিত অনুসরণ করা হয়।

বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেবার বিধান আগে বছরে দুইটি করে থাকলেও বর্তমানে একটি করে পরীক্ষা সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। এই পরীক্ষা যেহেতু তিনটি স্তরে অনুষ্ঠিত হয় [এমসিকিউ, লিখিত এবং ভাইভা পরীক্ষা] ফলে বছরে একটি করে পরীক্ষা নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করলেও এটি শিক্ষানবিশদের জন্য বিরাট একটি প্রাপ্তি হয়। কিন্তু সেই পরীক্ষাটি গত কয়েক বছর ধরে অনিয়মিতভাবে গড়ে প্রতি আড়াই বছরে একবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে! শিক্ষানবিশদের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাদের ক্ষোভ এটাই যে, নিয়ম মেনে প্রতি ৩ বছরে ঠিকই বার কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও উক্ত নির্বাচিত কমিটি আইনে বলা থাকলেও প্রতি বছর শিক্ষানবিশদের জন্য পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত করে না বা এ ব্যাপারে তারা উদাসীন থাকে।

আমি এমন শিক্ষানবিশকে চিনি যিনি ২০১৭ সালের একজন পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং সফলভাবে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পরেও ভাইভা পরীক্ষা না দিয়েই তাকে বিদেশে উচ্চতর আইন পড়তে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক দেরিতে অনুষ্ঠিত ভাইভা পরীক্ষার আগেই উক্ত বিদেশস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর ডাক পড়ায় তিনি ভাইভা পরীক্ষাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন! আবার এমন শিক্ষানবিশদেরকে চিনি যারা অনেকেই সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন- তাদের স্বপ্ন তারা আইনজীবী হয়ে একজন নিয়মিত প্র্যাকটিশনার হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু একবার এমসিকিউ পরীক্ষায় ফেল করার পরে পরবর্তী পরীক্ষাটির জন্য তারা ‍শুধুই অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। আজ হবে কাল হবে করে করে তাদের দিনযাপন খুবই পীড়া ও যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে তাদের মনের ভেতরে। অনেকেই পুরোদমে প্রস্তুতি শেষ করে নিয়ে আবারো পড়ছেন খুব ক্লিশে ভাব নিয়ে অথবা কেউ কেউ পড়াশোনা করা ছেড়েও দিয়েছেন। এভাবে এই সেক্টরের ভবিষ্যৎ পেশাজীবীগণ চরম অনিশ্চয়তায় আছেন তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে।

বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয় হাইকোর্টের আপিল বিভাগেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিধায় আপিল বিভাগ বার কাউন্সিল সংক্রান্ত একটি রায়ে তার পর্যবেক্ষণে মতামত জানিয়েছিলো এভাবে –

”It is seen that the Bar Council cannot perform its responsibilities properly. It cannot conduct the enrollment process of advocates properly and accordingly, the Judges of the Supreme Court have been entrusted with the responsibility.” [Civil Appeal 235 of 2014]

২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই রায়ের সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে ১২ টি পয়েন্টের সবশেষ পয়েন্টে আরো বলা আছে –

”The Bar Council shall complete the enrollment process of the applicants to be enrolled as advocates in the district courts each calendar year. ”

আইনে তো বলাই আছে, উপরন্তু আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণেও যা বলা আছে সে অনুযায়ী বিবেচনায় নিলে তা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ বলে বিশেষভাব মান্য করার বিধান থাকলেও সেটিও মান্য করা হচ্ছে না যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

এরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষানবিশগণ যে ছোট আকারে হলেও আন্দোলন শুরু করেছেন তা অতি স্বাভাবিক। এই আন্দোলনকে শুধু এবারের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ না করে সকল ভুক্তভোগী শিক্ষানবিশগণের উচিত হবে যেন এই আন্দোলন প্রতি বছর বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার নিশ্চয়তা প্রদান করে। নিজের শিক্ষানবিশকাল শেষ হবার পরে পরবর্তী শিক্ষানবিশদের প্রতিও যেন সহমর্মিতার হাত বাড়ানো অব্যাহত থাকে। কারণ, শিক্ষানবিশগণ জানেন আরেক শিক্ষানবিশের কষ্ট।

‘বাংলাদেশ শিক্ষানবিশ আইনজীবী সমিতি’ এর ব্যানারে সংগঠিত হওয়া এই আন্দোলনে বেশ কিছু দাবি আছে। তবে, আমার পরামর্শ থাকবে এই মুহূর্তে আন্দোলনে একটি বিষয়কে বিশেষভাবে ফোকাস করা আর সেটি হচ্ছে – প্রতিবছর পরীক্ষা নেবার জন্য একটি পরীক্ষার সূচি নির্দিষ্ট করে ঘোষণা করার দাবি। যেমন, প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করে তার পরবর্তী এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবারে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা এবং নভেম্বর মাসের ভেতরে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা। এরকম একটি একাডেমিক পরীক্ষার সূচি সাজিয়ে দাবিটি তোলা এবং এটিকে বার কাউন্সিল নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আকারে আদায় করা। তাহলে এটিকে একটি স্থায়ী এবং নিশ্চিত ব্যপারে পরিণত করা যাবে বলে আমি আশাবাদী।

 আন্দোলনকারী শিক্ষানবিশদের জন্য শুভকামনা আমার পক্ষ থেকে।

লেখক : আইনজীবী ও ‘আইনের ধারাপাত – MCQ মডেল টেস্ট বুক’ এর রচয়িতা এবং ফাউন্ডার – juicylaw.com