অ্যাডভোকেট জোবায়ের সাইফ

আসামি ধরতে পুলিশের শনাক্তকরণ মহড়া পদ্ধতি

শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) হলো আসামী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া। সাধারণত পুলিশ অপরাধ তদন্তে সংক্ষুব্ধ বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক আসামীকে শনাক্তকরনের জন্য এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ভিকটিম বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অপরাধীকে চিনতে পারেন না, তখনই পুলিশ অপরাধ তদন্তে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্তকরনের জন্য এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট জোবায়ের সাইফ

আমাদের সমাজে অনেক অপরাধই ঘটে যেই অপরাধের অপরাধীকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায় না বলে ১৯৪৩ সালে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল অর্থাৎ PRB এর ২৮২ এর প্রবিধান মতে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্তকরনের জন্য শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) প্রবর্তন করা হয়। এটি একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণিকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়া কেবলই পুলিশ বা অন্য কোন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তাদের তদন্ত কার্যে ব্যবহার করে থাকে ।

তবে সাক্ষ্য আইনের দৃষ্টিতে শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) দুর্বল এবং সমর্থনযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত।

 অধিকাংশ মামলার সিদ্ধান্তে আদালত অভিমত প্রদান করেন যে, শনাক্তকরণ মহড়া বা Test Identification Parade (TI Parade) গ্রহণযোগ্যতার জন্য ৩টি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। যথা-

  • সাক্ষীর নিকট আসামীকে নামে অপরিচিত হতে হবে।
  • ঘটনার এবং শনাক্তকরণ মহড়ার মধ্যবর্তী সময়ে সাক্ষী আসামীকে দেখার কোন সুযোগই পাবে না।
  • সাক্ষী আসামীকে শনাক্ত করতে ভুল করবে না।

 সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর যথাসম্ভব শীঘ্রই শনাক্তকরণ মহড়া অনুষ্ঠান করা আবশ্যক। কারণ মানুষ ভুলোমনা, মানুষের স্মৃতিশক্তি যে কোন সময় লোপ পেতেই পারে। যার ফলশ্রুতিতে সাক্ষীর ভুল হতে পারে এবং ভুল মানুষকে শনাক্ত করতে পারে, যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। উপমহাদেশের এবং আমাদের দেশের উচ্চ আদালসমূহের বিভিন্ন মামলায় সিদ্ধান্ত হলো , সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে শনাক্তকরণ মহড়া সম্পন্ন করা উত্তম।

 শনাক্তকরণ মহড়া ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক করাটাই বাঞ্ছনীয়, কারণ আইনের বিষয়বস্তুগুলি আইনের ব্যক্তিরাই ভাল বুঝতে পারেন।

 ১৯৪৩ সনের পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল বা PRB এর ২৮২ প্রবিধানসহ উচ্চ আদালতসমূহের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত অনুসারে আসামীকে শনাক্তকরনে সাক্ষীর সক্ষমতা যাচাই করনের সাথে সাথে নিম্নোক্ত বিষয়ে নজর দেওয়া আবশ্যক,

  • মহড়াটি তদন্তকারী কর্মকর্তা ছাড়া অন্য পুলিশ কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা আয়োজন করা আবশ্যক। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা মহড়া আয়োজনকালে উপস্থিত থাকতে পারেন।
  • আসামীকে তার ইচ্ছেমত লাইনের যে কোন স্থানে দাঁড়াতে দিতে হবে এবং তাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চত হতে হবে যে, সে লাইনের যে স্থানে আছে তাতে বা মহড়ার পদ্ধতিতে তার আপত্তি আছে কিনা?
  • মহড়ার স্থান থেকে সকল অনাকাঙ্খিত বা অননুমোদিত ব্যক্তিদের সরিয়ে দিতে হবে।
  • সাক্ষীগণ যাতে শনাক্তকরণ মহড়ার পূর্বে আসামীকে দেখার সুযোগ না পায় সে প্রতিবন্ধকতা রাখতে হবে এবং ফটো বা আসামীর বর্ণনা দ্বারা কোনরূপ সাহায্য করা যাবে না।
  • আসামীর দেহে দৃশ্যমান চিহ্নাদি থাকলে তা আড়াল করার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, গালে বড় ধরনের কাটা দাগ থাকলে আসামীসহ লাইনের সকল ব্যক্তির গালে কাগজ এঁটে দিতে হবে যাতে করে কাটা দাগ দৃশ্যমান না হয়।
  • মহড়া চলাকালে আসামী কর্তৃক উত্থাপিত প্রতিটি আপত্তি সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
  • যখন কোন সাক্ষী আসামীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়, তখন অবশ্যই স্মারকলিপিতে লিখতে হবে যে, সাক্ষী কোন প্রসঙ্গে আসামীকে শনাক্ত করলেন।
  • যদি কোন ভুল ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয় তবে তা অবশ্যই লিপিবদ্ধ করতে হবে।
  • একাধিক সন্দেহভাজন আসামী থাকলে প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সুতরাং অধিকাংশ অপরাধের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, প্রকৃত অপরাধিকে শনাক্ত করা যায় না বলে প্রতিনিয়তই আদালতের পক্ষে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভবপর হচ্ছে না। তাই শনাক্তকরন মহড়া প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে একটি বাস্তবমুখি পদ্ধতি। তবে, আইন ও আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে ভাবে শনাক্তকরণ মহড়া কার্যকর করার কথা বলা আছে সে ভাবে শনাক্তকরণ মহড়া কার্যকর করতে পারলেই প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা আদালতের পক্ষে সম্ভবপর হবে।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।