মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব

“ও আইনে পড়! বটতলার উকিল হবা?”

মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব :

ছায়ানটের সাথে যেমন বটতলার সম্পর্ক খুব গভীর তেমনি যারা আইন পড়ছেন বা উকিল হয়েছেন তাদের সাথেও বটতলার ঐতিহ্যগত সম্পর্ক্য বিদ্যমান। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আইন পড়ুয়াদের মানুষজন প্রথম দেখাতেই বলে, “ও আইনে পড়! বটতলার উকিল হবা?”

তথাকথিত এসব মহাজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে বটতলার উকিলদের সাথে আরও একখানা বিষয় ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত তা হল মিথ্যা কথা বলে টাকা কামানো! কিন্তু তাহারা মানিতে নারাজ যে, তাহাদের কৃত কুকর্ম ঢাকিতেই এই সকল করিতে হয় বৈকি!

ছোট একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ভদ্র সমাজের কারো আদরের দুলাল যখন কাউকে ধর্ষণ করে পুলিশের হাতে ধরা পরে, তখন তাদের বাক্য হয় এরূপ, “উকিল সাহেব! যত টাকা লাগে নেন, ছেলে যেন আমার ছাড়া পায়।”

যখন আদরের ছেলে মাদক হাতে আটক হয়, তখন বটতলায় যাতায়াত বেড়ে যায়। তখন যদি দু’চার খানি মিথ্যে যদি বলতেও হয় তবে তা তো আলালের ঘরের দুলালকে বাঁচানোর জন্যই! কিন্তু যখন আসামি খালাস পায় না তখন উকিলের বিদ্যা বা যোগ্যতা নিয়ে বেশ ব্যবচ্ছেদ হয়। কিন্তু আসলেই যে মিথ্যে দিয়ে আইন আদালত চলে না এটাই তার প্রমাণ। তাছাড়া অপ্রিয় সত্য হচ্ছে সমাজের মানুষ দুর্নীতি, ঘুষ, সুদ, নারী কেলেঙ্কারি, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপকর্ম যত কম করবেন তত বটতলার মিথ্যুকদের কাছে কম আসতে হবে।

যখন মিথ্যে বা হয়রানিমূলক মামলার শিকার হন বা অবৈধ বলপ্রয়োগ করে কারো পদ বা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, তখন আইনের প্রকৃত ব্যাখ্যা দিয়েই আপনার হারানো অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এই বটতলার মানুষরাই।

যারা ভাবেন, আইন-আদালত মিথ্যে কথায় চলে, তাদের বলি, আপনাদের কাছে আইন মলাটে ঘেরা ধারা-উপধারা, তবে মলাটের ভিতরের বাক্যের বাহিরে যাবার ক্ষমতা না আছে জজ সাহেবের না আছে উকিল মশায়ের।

আইন যখন পক্ষে যাবে তখন গুনগান আর বিপক্ষে গেলে (অপরাধ করার পরও) আদালতের সমালোচনা এটা আর নতুন কি!

আর ‘আদালতে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ শীর্ষক আলোচনা বিষয়ে কথা বলে বলে যারা গলা শুকাচ্ছেন, তারাই কিন্তু আদালতের আশ্রয়ে এমন সাহসী কথা বলতে পারছেন। আর পাশাপাশি আদালত কোন একক সংগঠন নয়, ফলে এর সাথে যে যে প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত, সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি, দক্ষ জনবল বা যোগ্যতার ঘাটতি কি কখনও ভেবে দেখেছেন?

স্বয়ং আদালতের বিচারক সংকট, লজিস্টিকস সাপোর্ট, জনবল, বাজেট-বরাদ্দ নিয়ে কতগুলো সভা সেমিনার হয় শুনি! দেশে এখনো অনেক সমস্যা সংকটের মাঝেও মানুষের কাছে বিশ্বাসের জায়গা আইন আদালত।

আর যারা আইন মানেই শুধু অর্ডার! অর্ডার! বোঝেন, তাদের বলি, আইন অর্থ নিয়ম। নিয়ম অনুসারে চললে দেশে হয়ত এত জটিলতা থাকতো না। আচ্ছা, আপনি কি নিয়ম করে সঠিক পথে গাড়ি চালান? আপনি কি নিয়ম মেনে বহুতল ভবন তৈরী করেছেন? আপনি কি নিয়ম মেনে কর দিচ্ছেন? ব্যাংকের ঋণের টাকা কি ঠিকমত পরিশোধ করছেন? আপনার বাসায় গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইন কি বৈধ? আপনি প্রশ্নপত্র কিনে বা ঘুষ দিয়ে চাকুরী করছেন না তো?

দেশের মানুষজন নিয়ম মানেন না বলেই এত অভিযোগ, যার প্রয়োগ আবার বটতলার উকিলের উপর। প্রকৃতির প্রতিটি জিনিস নিয়মানুসারে চলে, এই নিয়ম ভঙ্গ করলেই সমস্যা সৃষ্টি হবেই এটাই স্বাভাবিক। আর বার মাস কালো কোট জড়ানো মানুষগুলো এই নিয়ম রক্ষার জন্যই লড়াই করে চলেছে।

আমার আপনার মৌলিক অধিকার রক্ষার নমুনা হয়ত আপনাদের চোখে পরে না, কিন্তু ভাবুন তো যখন এন্টিবায়োটিকের যথাচ্ছ ব্যবহার বন্ধে, ভেজাল পণ্য বাজারজাত ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা, নদী রক্ষায় নদীকে যখন জীবন্ত সত্তা ঘোষণা, রিফাত-নুসরাত হত্যাকান্ডে আদালত ব্যবস্থা নেয়া, বালিশ বিলাসে পূর্ত মন্ত্রণালয়কে তলব, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান বন্ধে নির্দেশ আসে তখন তো আপনাদের মুখে অনেক সাধুবাদ শোনা যায়। এগুলো কাদের অবদান? ঐ বটতলার উকিলদের।

আবার অনেকে বলবেন, এসব কথার কথা, বাস্তবে প্রয়োগ নেই, ভাই! আমি আপনি বা আমাদের পরিচিত জনরাই এসব অবৈধ কাজ করছে, তাই আমরা এগিয়ে আসিনা এসব রোধ করতে। এখন যদি এসব রোধ করতে বটতলাবাসীই আসে, তখন তো বলবেন “শুধু মিথ্যে কথায় টাকা কামিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়নি, এবারে শুরু করেছে ক্যাডারি”

শুধু কি তাই। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনের ভূমিকা কতটুকু অনুমান করতে কয়েকটি নাম বলতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহসান,মহাত্মা গান্ধি, মোহম্মদ আলী জিন্নাহ, নেলসন ম্যান্ডেলা, তাঁরা সবাই আইনের ছাত্র। দেশ ও জাতি গঠনে তাঁদের অবদান চিরদিন অম্লান হয়ে বয়েছে, যা রবে চিরকাল।

কোন পেশা বা পেশার মানুষকে ছোট অথবা হীন করার জন্য এই লেখা লিখিনি আমি। এটা ভেবে থাকলে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।

“Ubi jus Ibi remedium” (it is a Latin legal maxim which means “where there is a right there is a remedy”. )

হ্যাঁ, আপনার হারানো অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আমরাই নিয়েছি, জ্বী! আমরা আইন পড়ি, বটতলায় আমাদের বসবাস, আবার আমরাই দেশ, জাতি, সমাজ গঠন করি।

লেখক : শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।