অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

তালাক দেয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করবেন যেভাবে

সিরাজ প্রামাণিক:

অনেক আশা-স্বপ্ন নিয়ে দুজন মানুষ একসঙ্গে পথচলা শুরু করে। সেই পথচলা সবসময় মসৃণ হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দুজনের সম্পর্ক এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যাতে বিচ্ছেদই হয়ে উঠে একমাত্র সমাধান। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, পরস্পর মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমণ্ডিত জীবনযাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন একে-অপরকে তালাক দিতে পারে।

মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে- ‘কোনো পুরুষ তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যে কোনো পদ্ধতিতে ঘোষণার পরই তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও উহার নকল দিবেন’ অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি।

চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)।

তালাক কার্যকরের পর যদি তালাক দেয়া স্ত্রীকে আবার গ্রহণ করতে চান, তবে আগের মতো নিয়ম মেনে আবার বিয়ে করতে হবে। তবে তালাক দেয়ার পর যে ৯০ দিন সময় হাতে থাকে, ওই দিনের মধ্যে যদি তালাক দেয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চান, তা হলে একটি আবেদনপত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে পুনরায় তালাক দেয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতো সংসার করতে পারবেন। তালাক দেয়ার পর যে সময় হাতে থাকে, তার মধ্যে স্ত্রীকে ভুল স্বীকার করে গ্রহণ করলে কোনো রেজিস্ট্রেশন লাগবে না। আর যদি তালাক কার্যকরের পর স্বামী-স্ত্রী আবার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চান তাহলে তারা নতুন করে বিয়ে করে নিলেই হবে। একটি নতুন সাধারণ বিয়ে যেভাবে হয় সেভাবে বিয়ে করে নিলেই হবে।

কারণ তালাক সম্পূর্ন কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগন আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।

পুনরায় বিয়ের পর স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে থাকেন, তবে স্ত্রী তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেবেন। এমনকি যদি কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্ত্রী তালাকের বিধান থাকে, তবে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন।

মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ (৫) ধারায় বলা আছে, কোন আইনই স্ত্রীকে একই স্বামীকে, যার সাথে তালাক হয়েছে, বিয়ে করা থেকে বিরত করবে না। তবে তিনবার এমন কাজ করা যাবে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ তিনবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে একই স্বামী বিয়ে করতে পারবেন।

অনেক মুসলিম সমাজেই হিল্লা বিয়ে নামক এক পদ্ধতির কথা বলা আছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে যদি স্বামী আবার বিয়ে করতে চান তাহলে ওই স্ত্রীকে স্বামী ব্যতীত অন্য আরেকজন ব্যক্তির সাথে আগে বিয়ে দিতে হবে। সেই বিয়ে কার্যকর করা হবে অর্থাত স্বামী-স্ত্রী ‘কনজুগাল লাইফে’ প্রবেশ করবেন। তারপর পূর্বের ডিভোর্স দেওয়া স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন।

তবে ইসলাম ধর্ম মতেও, হিল্লা বিয়েকে সমর্থন করা হয় না। অনেক ইসলামিক মনীষী এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। মূলত, তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে ওই স্বামীর কোন আইনী বাঁধা নেই। এখানে বলে রাখা ভাল যে, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে বিয়ে করলেও নতুন এই বিয়েও বিবাহ রেজিস্ট্রারের অফিসে রেজিস্টার করা লাগবে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com