অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

পরকীয়া প্রেমের করুণ পরিণতি বনাম আমাদের আইন-আদালত

সিরাজ প্রামাণিক:

স্বামী প্রবাসী। ভালই আয় করে। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল ছন্দা’র (ছদ্মনাম)। প্রতিদিনই স্বামীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। স্বামী টাকা পাঠান খরচের চেয়েও বেশ বেশী। সেই টাকায় বাসা ভাড়া, দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে আবার কিছু জমাতেও থাকে। সব মিলিয়ে বাঙালী সমাজের এক আদর্শ পরিবার। কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই সংসারে নেমে আসে আসে এক অমানিশার অন্ধকার। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সেই সোনার সংসার তাসের ঘর হয়ে যায়। প্রবাসী স্বামী স্ত্রীর বাচন ভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন বুঝতে পারে। ফোন দিলেও ধরে না। আবার ধরলেও টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দেয়। স্বামী বুঝতে পারে, কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে নানা ঝামেলার কথা শোনায়। এভাবেই কেটে যায় বছর দুই। বিদেশ বসেই স্বামী জানতে পারে তার স্ত্রী আর আগের মতো নেই। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। অবশেষে প্রাণের টানে স্বামী তার দেশে ফিরে আসে। জানতে পারে তার স্ত্রীর সব কর্মকান্ড। তবে এতোদিনে সব শেষ। স্ত্রীরও আর বুঝতে বাঁকী থাকে না এতদিন সে মরিচিকার পেছনে ছুটেছে। ভন্ড প্রেমিকের প্রেমে সে ছিল মত্ত। কিন্তু ততদিনে সব শেষ তার। বিদেশ থেকে স্বামীর পাঠানো টাকা, জমানো সব সঞ্চয়-অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল গোপন প্রেমিকের হাতে। সেই গোপন প্রেমিকের আসল চেহারা যখন সে দেখে ফেলে ততদিনে তার স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ছন্দা এখন সব হারিয়ে পথে বসেছে। গোপন প্রেমিক প্রেমিকার দ্বন্ধ থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে তাদের নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনী।

বাড়ি ভাড়ার সূত্র ধরে পরিচয়। পরিচয় থেকে পরকীয়া প্রেম। প্রেম থেকে অবৈধ সম্পর্ক। বাড়ির মালিকের সন্দেহ হলেই ভাই-বোন বা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নতুন নতুন বাসায় বসবাস। প্রেমের টানে এভাবেই কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে কেটে গেছে দীর্ঘ দুই বছর। অবৈধ মেলামেশার ভিডিওকে পুঁজি করে প্রেমিক ততদিনে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার মিলিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ১০ লাখ টাকার মালামাল। এখানেই শেষ নয়, প্রেমিকের কথায় দুই দুই বার গর্ভে জন্ম নেওয়া দুটি ভ্রূণকে হত্যা করেছে প্রেমিকা। বিদেশ ফেরত স্বামী আর তাকে গ্রহণ করেননি। এখন নিঃস্ব হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিচারের আশায়। আদালতে এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তদন্তে জানা যায়, ঘটনাটির সূত্রপাত ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি। ছন্দা (ছদ্মনাম) নামের ওই নারী একটি ফ্ল্যাট খুঁজছিলেন। বাড়ি খোঁজার সূত্রধরে জনৈক এক দারোয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। দারোয়ানের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ওই নারী মাসিক ১৩ হাজার টাকায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। বাসায় স্বামী ও দুই সন্তানের থাকার কথা। ওই বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ওই নারী বসবাস শুরু করেন। দারোয়ানের মাধ্যমে প্রেমিকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই নারীর। ঘটনার সময় ওই নারীর স্বামী বিদেশ ছিলেন। স্বামী না থাকায় নিজে দুই রুম রেখে এক রুম ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া দেন। যদিও বিষয়টি তিনি বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়া অন্য ব্যাচেলরদের জানাননি। প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ঘনিষ্ঠতা থেকে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেম থেকে তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ওই নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো ওই বাসায় বসবাস করতে থাকে। অবৈধ সম্পর্কের নানা ছবিও ভিডিও করে রাখে ওই ভন্ড প্রেমিক।

প্রেমিক একদিন ওই নারীকে বলে, নতুন বাসা ভাড়া করা হয়েছে। নতুন বাসার ভাড়া ও ফার্নিচারসহ অন্য মালামাল কেনার জন্য ৬০ হাজার টাকা দরকার। এরপর প্রেমিক অত্যন্ত কৌশলে ওই নারীর স্বর্ণালঙ্কারগুলো গোপনে নতুন ভাড়া বাসায় রাখার কথা বলে। প্রেমিক বলে, আগে আগে নিয়ে না রাখলে শেষ দিকে নেওয়ার সময় কেউ সন্দেহ করলে চোর-ডাকাত পিছু নিতে পারে। এমন কথায় বিশ্বাস করে ছন্দা তার ৮ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার প্রেমিককে দেয়। প্রেমিক সেগুলো নিয়ে বাসায় রাখার কথা বলে বের হয়। এরপর থেকেই প্রেমিক ওই পুরুষের আর হদিস নেই। উপরের এ গল্পটি বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ চাউর হয়ে উঠে।

পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়। ইংরেজ শাসনকালে তৈরি এই আইনের ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক। এমনটিই রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর’ ২০১৮ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না।

ভারতে ১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইনের ৪৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি কোনও মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। বিবাহিত নারীকে ‘অপরাধের শিকার’ বিবেচনা করে আইনে সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষকেই দোষী হিসেবে গণ্য করার বিধান ছিল। এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন জনৈক যোশেফ শাইন। পরকীয়া অপরাধ নয় জানিয়ে এ সংক্রান্ত দেড়শ বছরের পুরনো একটি আইন বাতিল করে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

পরকীয়ার সাজা সংক্রান্ত বাংলাদেশ দ-বিধির ৪৯৭ ধারা কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ৮ জুলাই’২০১৯ সোমবার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান এ রিটটি দায়ের করেন। রিটে ৪৯৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার আবেদনও রয়েছে।

দ-বিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরুন্ত স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হয় তা আইনত বৈধ। এই আইন সংবিধানের ২৭,২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটা অদ্ভুত ও বৈষম্যমূলক।

বাংলাদেশ দ-বিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোন লোকের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরুপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ব্যতীত যৌন সঙ্গম করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-ে অথবা অর্থদ-ে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোন সাজা পাবে না। এ বিষয়ে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪ সন্নিবেশিত রয়েছে।

মহিলা আসামী হতে পারে না। তবে ওই পুরুষটির সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ওই মহিলার সাথে যৌন সঙ্গম করার সময় আসামী জানত অথবা জানার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল যে, যৌণ সঙ্গমকারী মহিলা অপর কোন ব্যক্তির স্ত্রী।

পাঠক এ লেখাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুর ইসলামের বিখ্যাত ‘পূজারিনী’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়েই শেষ করতে চাই। ‘নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো, এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো! ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।’

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com