চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) এস এম মাসুদ হাসান

চেক ও নথি হারানোর ‘মাস্টার’ পেশকার মাসুদ

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) এস এম মাসুদ হাসান। যে আদালতে দায়িত্ব পালন করেন, সেখানেই কোনো না কোনো অঘটন ঘটান। তিনি যে আদালতে দায়িত্ব পালন করেন, শুধু সেই আদালত থেকেই হাওয়া হয়ে যায় চেক প্রতারণা মামলার গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স চেক! এক বছরের ব্যবধানে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থেকে চেক হারানোর অভিযোগ উঠেছে। চেক হারানোর ঘটনায় বিচারকের নেতৃত্বে গঠিত বিভাগীয় তদন্তেও দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। একের পর এক অঘটন ঘটনায় এখন চেক হারানোর ‘মাস্টার’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন আইনজীবীদের কাছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার তিনটি চেকসহ হাওয়া হয়ে গেছে তিনটি চেক প্রতারণা মামলার সব নথি। এর আগে চট্টগ্রাম দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মামলার নথি থেকে ১২টি চেক হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত হন মাসুদ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার তিনটি চেকসহ চেক প্রতারণার তিনটি মামলার নথিপত্র হারানোর ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে মাসুদকে আদালত থেকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু পেশকার মাসুদ আদালতের দেওয়া সেই শোকজের কোনো জবাবও দেননি। এ তিনটি মামলা তিনজন রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি পরিচালনা করতেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম পঞ্চম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ বড়ূয়া বলেন, ‘চলতি জুলাই মাসেই এক কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি চেক প্রতারণা মামলার সাফাই সাক্ষী নিতে গেলে আদালতে মামলার নথি ও চেকটি উপস্থাপন করতে পারেননি পেশকার মাসুদ। তিনি শুনানির সময় আদালতকে জানান, মামলার নথি পাওয়া যাচ্ছে না। রায়ের কাছাকাছি চলে যাওয়া একটি মামলার নথি ও চেক গায়েব হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক ঘটনা। এ ঘটনা পেশকার মাসুদই ঘটিয়েছেন। কারণ, আগের দিন আমি নিজেই মামলার নথিটি পেশকার মাসুদের কাছে রেখে এসেছিলাম।’

একই আদালতের অন্য এপিপি অ্যাডভোকেট সুভাষ কান্তি রুদ্র বলেন, ‘এক কোটি ১০ লাখ টাকার একটি চেকের মামলায় সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য একদিন আগে নথিটি আদালতেই স্টাডি করেছিলাম। কিন্তু পরের দিন সাক্ষী আসার পর সেই মামলার নথি ও চেক পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান পেশকার মাসুদ। এ ঘটনার সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত। তিনি যে আদালতে দায়িত্ব পালন করেন, সেই আদালতেই নথি গায়েব হয়ে যায়।’

অন্য এপিপি অ্যাডভোকেট মো. মহিবুল্লা চৌধুরী বলেন, ‘আদালত থেকে কখনও কোনো নথি ও চেক গায়েব হয় না। কেউ না কেউ তা গায়েব করেন। পেশকার মাসুদই নথি ও চেকগুলো গায়েব হওয়ার ঘটনার মূল হোতা। তাকে রিমান্ডে নিলে সব একদিনেই বের হয়ে যাবে। মাসুদ এখন আদালতে চেক হারানোর মাস্টার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন।’

আদালত সূত্রে জানা গেছে, তিনটি চেকসহ নথি হারানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মো. জহির উদ্দিনের আদালত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত বরাবর চলতি জুলাই মাসে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে বিচারক উল্লেখ করেছেন, ‘২০১৯ সালের ১৯ মে সংশ্নিষ্ট আদালত চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অভিযোগ করেন, একটি মামলার নথি পাচ্ছেন না। এ ঘটনার পর ২০ মে আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস এম মাসুদ হাসান ও অফিস সহায়ক তপন কান্তি দে-কে শোকজ করা হয়। একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া চেক প্রতারণার দায়রা নম্বর ১৮১১/১৮ মামলা, দায়রা নম্বর ১৮১৪/১৮ এবং দায়রা নম্বর ১৮১৫/১৮ মামলা তিনটির নথি বিচারকের কাছে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। যথাযথভাবে অবগত করার পরও মাসুদ ও তপন কেউ কারণ দর্শানোর জবাব দাখিল করেননি।’ চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘অত্র (পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ) আদালতে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় বিভিন্ন নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।’

অন্য আদালতে ১২ চেক গায়েবে বিচারকের তদন্তে অভিযুক্ত হন পেশকার মাসুদ :
চট্টগ্রামে মামলার নথি থেকে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার ১২টি চেক উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিভাগীয় তদন্তে পেশকার এস এম মাসুদ হাসানকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজের কাছে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মো. জহির উদ্দিন ১২ চেক হারানোর ঘটনায় তাকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘সংশ্নিষ্ট আদালতের (দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ) বিচারক এজলাস থেকে নামার পর এবং আদালত চলাকালীন অভিযুক্ত বেঞ্চ সহকারী একটি ব্যাগ নিয়ে আদালত ত্যাগ করেন। তার ফোন বন্ধ থাকে। সংশ্নিষ্ট বিচারক অফিস ত্যাগ করার পর পুনরায় অফিসে আসা এবং সংশ্নিষ্ট বিচারক অফিস ত্যাগ করার পর উল্লেখিত চেকসহ দলিলাদি হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যদি দলিলাদি আদালত রুমের ভেতর অন্যান্য নথির সঙ্গে মিশে যেত, তাহলে তা খুঁজে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চেক সরিয়ে নেওয়ার কারণে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অভিযুক্ত এস এম মাসুদ হাসান তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অসততার পরিচয় দিয়েছেন। মাসুদের কর্তব্যে অবহেলার কারণে এরূপ ঘটেছে।’

২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ইমপেক্সের মালিক এস এম পারভেজ আলম বাদী হয়ে একটি চেক প্রতারণা মামলা করেন চট্টগ্রাম আদালতে। মামলায় নগরীর পাঁচলাইশ থানা এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল আল বকরের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগ আনেন। বাদীকে দেওয়া আসামির ১২টি চেক ব্যাংকে অপর্যাপ্ত তহবিলের জন্য ডিজঅনার হওয়ায় মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলা দায়ের করার পর আদালত সমন দিলেও আসামি ফয়সাল হাজির না হয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে নগরীর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে মামলার সাক্ষ্য দিতে গেলেই নথি থেকে ১২টি চেক গায়েব হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সবার সামনে আসে। এরপর পেশকার মাসুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এক সদস্যের বিচারকের তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়। সমকাল