প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলার আবেদন, অধিকাংশই খারিজ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ করায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার এক ডজন আবেদন হয়েছে, যার অধিকাংশই খারিজ করে দিয়েছে আদালত।

রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি না থাকায় ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, ঝালকাঠি, জামালপুর ও খুলনার আদালতে আটটি মামলা খারিজ হয়ে গেছে।

একই অভিযোগে চট্টগ্রাম, সিলেট ও নেত্রকোণায় তিনটি মামলার আবেদন আদালতের আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। আর নাটোরের আদালত একটি মামলার অভিযোগ পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে বলেছে।

দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘শারি’র পরিচালক প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক।

ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে যান প্রিয়া। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ (ডিজঅ্যাপিয়ার্ড) হয়েছেন।

তার ওই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় দেশের বিভিন্ন মহলে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই’ প্রিয়া সাহা এই ধরনের ‘বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ’ করেছেন।

এরপর রোববার (২১ জুলাই) ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মামলার আর্জি জমা পড়ার খবর আসতে থাকে। দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার আবেদনকারীই সরকার সমর্থক কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

এরপর দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, প্রিয়া সাহা কেন ওই বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে তার ব্যাখ্যা না শুনে তড়িঘড়ি কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ঢাকা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়্যেদুল হক সুমন এবং ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইব্রাহিম খলিল রোববার সকালে ঢাকার হাকিম আদালতে দুটি মামলার আবেদন করেন প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে। দণ্ডবিধির ১২৩ (এ), ১২৪ (এ) ও ৫০০ ধারায় দায়ের করা এসব আবেদনে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও চাওয়া হয়। সুমনের আবেদনের শুনানি হয় ঢাকার মহানগর হাকিম জিয়াউর রহমানের আদালতে। আর ঢাকার মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মো. নোমান শোনেন খলিলের মামলার আরজি। শুনানি শেষে দুই আবেদনই খারিজ হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় মহানগর হাকিম জিয়াউর রহমান বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করতে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। ওই ধারায় রয়েছে যে, সরকার বা সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো অফিসারের আদেশ বা কতৃত্ব বলে দায়ের করা নালিশ ব্যতীত কোনো আদালত এ ধরনের কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ আমলে নেবেন না।”

চট্টগ্রাম
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন এস এইচ এম হাবিবুর রহমান আজাদ নামের এক আইনজীবী। মহানগর হাকিম আবু সালেহ মোহাম্মদ নোমান তার আর্জি শুনে ২৫ জুলাই বিষয়টি পরবর্তী আদেশের জন্য রাখেন। আইনজীবী আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে যে অভিযোগ প্রিয়া সাহা করেছেন, তা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ শামিল। “এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে প্রিয়া সাহা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা চলছে, তা ব্যাহত করার চেষ্টা করছেন। সে কারণে সংক্ষুব্ধ হয়ে আমি ১২৪ (ক), ৫০৫ ও ৫০৫ (ক) ধারায় এ মামলা করেছি।”

সিলেট
সিলেট মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রিমাদ আহমদ রুবেল রোববার সকালে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করেন। তার আর্জি শুনে বিচারক মোস্তাইন বিল্লাহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিষয়টি আদেশের অপেক্ষায় রাখেন বলে রুবেলের আইনজীবী মোহম্মদ তাজ উদ্দিন জানান। যুবলীগ নেতা রুবেলের আবেদনে বলা হয়, “প্রিয়া সাহার মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট অভিযোগের কারণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, এবং তা সুস্পষ্টরূপে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।”

খুলনা
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের দুটি মামলার আবেদন খারিজ করেছে খুলনার আদালত। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান জামাল ও মদন কুমার সাহা রোববার মহানগর হাকিম মো. আমীরুল ইসলামের আদালতে আবেদন দুটি করেন। নিয়ম অনুযায়ী সরকারের অনুমতি না থাকায় বিচারক দুটি আবেদনই খারিজ করে দেয় বলে ওই আদালতের পেশকার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ জানান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত। মো. আসাদ উল্লহ নামের এক ব্যক্তি রোববার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই আবেদন করেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নেওয়ায় বিচারক অভিযোগটি খারিজ করে দেন। আসাদ উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য প্রিয়া সাহা মিথ্যাচার করেছেন। এটি আমাকে আহত করেছে। তাই আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার আর্জি জানিয়েছিলাম।”

যশোর
রাষ্ট্রদ্রোহ এবং নির্বাচিত সরকারকে ‘উৎখাতের ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগে যশোরে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে মামলার একটি আবেদন খারিজ করেছে আদালত। যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম মোস্তফা কামাল রোববার সকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই আবেদন করেন। তার আর্জিতে বলা হয়, “প্রিয়া সাহা মিথ্যা অভিযোগ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্য এটা চরম অবমাননাকর।” শুনানি শেষে বিচারক বিষয়টি আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। পরে সরকারের অনুমতি না নেওয়ার কারণ দেখিয়ে বিকালে আবেদনটি খারিজ করে আদেশ দেন।

ঝালকাঠি
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে ঝালকাঠির আদালত। ঝালকাঠি শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের ভারপ্রাপ্ত জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. ছবির হোসেন সকালে এ অভিযোগ দায়ের করেন। সেখানে বলা হয়, “প্রিয়া সাহার বক্তব্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতা সৃষ্টিকারী। তার উক্তির ফলে শ্রেণি বিশেষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে, শান্তি ভঙ্গ হতে পারে এবং বিদেশিদের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।” সকালে তার আর্জি শুনে ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এএইচএম ইমরানুর রহমান বিষয়টি আদেশের অপেক্ষায় রাখেন। পরে বিকালে আবেদনটি খারিজ করে আদেশ দেন তিনি।

নাটোর
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি অভিযোগ পাওয়ার পর তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নাটোর প্রতিনিধি নাসিম উদ্দিন রোববার দুপুরে নাটোরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে ওই মামলার আবেদন করেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট এবং দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগ এনে সেখানে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ আটজনকে সাক্ষী করা হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী আলেক শেখ জানান, নাসিম উদ্দিনের বক্তব্য শুনে বিচারক বিষয়টি তদন্ত করে ৬ অগাস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নাটোর সদর থানার ওসি কাজী জালাল উদ্দিনকে নির্দেশ দেন।

নেত্রকোণা
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে একটি মামলার আবেদন আদেশের অপেক্ষায় রেখেছে নেত্রকোণার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত। ‘টিম নৌকা’ নামে একটি যুব সংগঠনের সভাপতি একেএম আজাহারুল ইসলাম রোববার আদালতে ওই আবেদন করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়াও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, জাতিগত বিদ্ধেষ সৃষ্টিসহ পাঁচটি ধারায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় সেখানে। আজহারের আইনজীবী ফজলে রাব্বি খান জানান, বিচারক মো. হামিদুল হক বাদীর জবানবন্দি শুনে বিষয়টি আদেশের জন্য অপেক্ষমান রেখেছেন।

জামালপুর
প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার একটি আবেদন খারিজ করে দিয়েছে জামালপুরের হাকিম আদালত। জামালপুর জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রাসেদুল ইসলাম খোকন রোববার জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ওই মামলার আবেদন করেন। সেখানে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও চাওয়া হয়। জেলা আইজীবী সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ জানান, বিচারক মো. সোলায়মান কবীর শুনানি শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন। বিডিনিউজ